Health

Health Sector Advertisements: সুস্থ হওয়ার ঠিকানা? না কি মৃত্যুভয় দেখিয়ে ব্যবসা? স্বাস্থ্য-বিজ্ঞাপন নিয়ে কিছু প্রশ্ন

পুজোর বাজারে জামা, জুতো কিনতে গিয়ে তার সঙ্গেই চোখে পড়ে ‘এ বার পুজোয় হাঁটু বদলান’ লেখা।

Advertisement

ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২২ ০৬:৫১
Share:

প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন আর বাণিজ্যিক কারণে বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য থেকেই যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শরীর সম্পর্কে সতর্ক হতে গিয়ে আজকাল বড্ড বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। বেসরকারি হাসপাতালগুলি যে ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের সতর্ক করতে চায়, সেগুলি তো ওই ভয় থেকে পরিত্রাণ দিচ্ছেই না, বরং আরও বেশি ভয়ের চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। শুধু বিজ্ঞাপন নয়, নেটমাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থা সারা ক্ষণ যে ভাবে আমাকে অনুসরণ করছে, তাতে নাজেহাল হয়ে পড়ছি। এ সব ভাবনা যাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত, তাঁরা কি ওই সব ভয় ও আতঙ্কের কথা কি ভেবে দেখেছেন? না কি সাধারণ জনের ভয়কে উসকে দিয়ে বাণিজ্যিক প্রসিদ্ধির পথে হাঁটতেই ওঁরা অভ্যস্থ হতে চান!

Advertisement

প্রতিবেশী বৃদ্ধের মৃত্যুর পর মোবাইলে সার্চ করেছিলাম, শববাহী গাড়ি কোথায় পাওয়া যেতে পারে! এক সার্চেই চলে এসেছিল অনেকগুলো যোগাযোগের নম্বর। সেখান থেকেই একটা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘শেষের খেয়া’ আনা হয়েছিল। প্রতিবেশী পরিবারের শূন্যতা কাটতে না-কাটতেই অদ্ভূত সমস্যায় পড়লাম। ‘সার্চ হিস্ট্রি’র হিসাবনিকাশ রেখেই সম্ভবত এর পর থেকে নেটমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আসতে শুরু করল অন্তেষ্ট্যির প্রয়োজনীয় উপকরণের নানা ধরনের বিজ্ঞাপন। রাত-বিরেতে আচমকা নিজের মোবাইলে ওই সব ছবি ও বিজ্ঞাপন দেখে স্বাভাবিক ভাবেই আঁতকে উঠতে হয়! কারণ, মনের কোণে উঁকি মারতে শুরু করে মৃত্যুবোধ।

মৃত্যু এতটাই আকস্মিক আর অমোঘ যে, তা নিয়ে চিন্তা বা কল্পনার অন্ত নেই। সুস্থ থাকা, চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা সব কিছুর সঙ্গেই প্রকারান্তরে জড়িয়ে থাকে মৃত্যুকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখা যায়। শহরের অলিগলিতে একা একা হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই অ্যাম্বুল্যান্সের তীক্ষ্ণ সাইরেন মনের কোণে যে আশঙ্কা তৈরি করে, তা থেকে নিজের ফোনে ‘এমার্জেন্সি’ হিসাবে ‘সেভ’ হতে থাকে জরুরি পরিষেবায় চিকিৎসক, ব্লাড ব্যাঙ্ক, অ্যাম্বুলেন্স বা দিন-রাত খোলা চিকিৎসা কেন্দ্রের যোগাযোগের নম্বর। সংবাদমাধ্যমে কোনও জটিল রোগের সমাধান বা চিকিৎসকদের সাফল্য মনের ভিতর এক ধরনের উৎসাহও তৈরি করে এই ভেবে যে, মৃত্যুকে জয় করা গিয়েছে। সার্বিক ভাবে মানব সভ্যতায় যুদ্ধজয়ের যে ধারাবিবরণী রয়েছে, সেখানে গৌরবের মুকুটে পালক গাঁথা হতে থাকে চিকিৎসায় সাফল্যের খবরে। তাই মৃত্যু, মৃত্যুভয় এবং মৃত্যুকে জয় করার যে বুনোন, তার মধ্যে দিয়েই সমাজ সভ্যতার উপাদানের বিবর্তন ঘটে চলেছে।

Advertisement

‘পোস্ট জিনোম’ এবং সর্বজন ব্যবহৃত প্রযুক্তি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য মানুষকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত করেছে। গুগ্‌ল করে নিজেরাই জানতে পারি নানা তথ্য। দেখে নিতে পারি কোনও সমস্যার সমাধান। অন্য সব কিছুর সঙ্গে নিজের স্বাস্থ্যের বিষয়েও গুগ্‌ল করে নেওয়ার মধ্যে আসলে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়াই থাকে। কিছু উপসর্গ, প্রাথমিক লক্ষণ যা খুব সামান্য কিছু থেকে অনেক জটিল রোগের বার্তাবাহক— তার চিহ্ন দেখে এক বার গুগ্‌লে সার্চ করে নেওয়ার মধ্যে আসলে সেই মৃত্যু আর দুর্ভোগ সংক্রান্ত দুশ্চিন্তাই কাজ করে। তাই কেবল উপসর্গ দেখে খুঁজে খুঁজে কী রোগ হয়েছে তা দেখা ছাড়াও এর ঘরোয়া সমাধান, কী কী ওষুধ ব্যবহার করা হয়, ডাক্তারের কাছে গেলে কী বলতে পারেন— এর একটা প্রাথমিক খসড়া নিজের মাথায় তৈরি হয়ে যায়। গুগ্‌লে সার্চ করে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া আধুনিক সময়ের সব থেকে বড় রোগ! এই উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আর নিজে নিজে সার্চ করার উদ্যোগকে কাজে লাগিয়েই চলছে স্বাস্থ্য আর চিকিৎসা পরিষেবার একটা বড় ক্ষেত্র। বিপদ যখন খুশি আসতে পারে, আগে থেকে সতর্ক থাকুন— এই ‘ক্যাচ লাইন’কে সামনে রেখেই সামগ্রিক চিকিৎসা পরিষেবার একটা প্রক্রিয়া চলছে।

শরীর সম্পর্কে সতর্ক হতে গিয়ে আজকাল বড্ড বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। প্রতীকী ছবি।

সভ্যতার অগ্রগতি মানে আসলে সমাজ উপাদানের পরিবর্তন। এই সমাজ উপাদানের মধ্যেই মেডিক্লেম, ক্যাশলেস, বাড়ি পর্যন্ত ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, বছরে এক বার ফ্রি শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা আস্তে আস্তে জুড়ে গিয়েছে। তার সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছে (ঠিক বেড়াতে গিয়ে ভাল হোটেলের ডিল খোঁজার মতন) বিভিন্ন নার্সিংহোমের আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা। আলাদা পরিষেবায় খরচের তারতম্য মনের কোণে খুব সূক্ষ্ম একটা অপ্রাপ্তি রেখেই দেয়। অন্য আর এক জন রোগীর সঙ্গে ঘর ভাগ করে নেওয়া, আর একা একটা সম্পূর্ণ কেবিন নেওয়া— চিকিৎসায় আলাদা করে কোনও ফারাক তৈরি না করলেও মনের ভিতর একটা অস্বস্তি থেকেই যায় অনেকের।

এই অস্বস্তিকে কাজে লাগিয়েই শহর জোড়া হোর্ডিং পড়ে— ‘বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরুন আমাদের সঙ্গে’, ‘মাঝরাতে আমরা আপনার দরজায়’… এই সমস্ত লাইন যতখানি ভরসা দেয়, তার থেকে অনেক বেশি মনের ভিতর থেকে শঙ্কাবোধকে মাথচাড়া দেওয়ায়। প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন আর বাণিজ্যিক কারণে বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য থেকেই যায়। সতর্কীকরণ বা সরকারি প্রচারের সঙ্গে হঠাৎ রাতে বিপদ বা আইসিইউ-কে অন্য ভাবে (I See U) লিখে মোটেই ভরসার কথা বলা হয় না, বরং প্রতি মুহূর্তে আর একটু করে দুর্ঘটনা বা মৃত্যু সম্পর্কে আতঙ্কিত করে তোলে।

পুজোর বাজারে জামা, জুতো কিনতে গিয়ে তার সঙ্গেই চোখে পড়ে ‘এ বার পুজোয় হাঁটু বদলান’ লেখা। ছবিতে বাচ্চা একটি ছেলের সঙ্গে দৌড়চ্ছেন বয়স্ক এক জন। জামা, জুতোর মতনই হাঁটু বদলানোটাও উৎসবেরই অংশ করে ফেলার মধ্যে যতটা বেশি ভোক্তার উৎসাহ, তার থেকেও বেশি বিক্রেতার। কারণ হাঁটু খারাপ হোক এটা কোনও ভাবেই কারও চাওয়া হতে পারে না। বদল তো অনেক দূর। সদ্যোজাত শিশুর ছবি দিয়ে দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসার বিজ্ঞাপন আসলে অন্য বাবা-মায়েদের ভাল থাকাকেই বিঘ্নিত করে। দোকানে ঢোকার মুখে যদি বড় বড় করে গ্লো সাইনবোর্ডে লেখা থাকে, ‘ক্যানসারের ওষুধে এ বার আকর্ষণীয় ছাড়’— তা কোনও ভাবেই চৈত্র সেলের সমগোত্রীয় হতে পারে না।

যাঁরা যুক্তিবাদী, যাঁরা সামাজিক ঘটনা পরম্পরার দিকে নজর রাখেন, তাঁরা ঝাঁড়ফুক, তুকতাক করা বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একই ভাবে অভিযোগ করতেন যে, মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের বিভিন্ন স্বার্থসিদ্ধি করছেন ওঁরা। অমুক বয়সে হাঁটুর মালাইচাকি ঘুরে যাওয়া, তমুক বয়সে মাথার রোগ বলে যে ভাবে তাঁরা তাবিজ-কবচ বা নিজেদের দায়িত্বে পুরো বিষয়টাকে নিতে চাইতেন, সমাজ সভ্যতার উপাদানের পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সেই জায়গাতেই নতুন রূপে শরীর সংক্রান্ত আশঙ্কার বিপণন চালু হয়েছে। তাই মাথায় টিউমার, বোন ম্যারো ট্রান্সফার— ছবি-সহ বড় করে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে সুস্থ মানুষদের মানসিক ভাবে নেতিবাচকই করে তোলে।

এর পাল্টা প্রশ্ন আসতেই পারে যে, কোনও হাসপাতালে নির্দিষ্ট কী কী চিকিৎসা হয় তা জানানোর জন্যই তো এই বিজ্ঞাপন। কিন্তু স্বাস্থ্যের মতন গভীর এবং সংবেদনশীল বিষয়ে এগুলি চিকিৎসকদেরই নির্দেশ দেওয়া প্রয়োজন। বাজার করার মতন শরীরের বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে নিজেরাই খোলা বাজারে ঘুরলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না। শরীর থাকলে খারাপ হবেই। এ চিরন্তন সত্য। সতর্ক হয়ে থাকা আর আতঙ্কে থাকা এক নয়। তাই আমাদের কথা ভেবে কেউ কেউ ছুটিহীন দিন কাটানোর কথা লেখেন বা কাউকেই ফেরান না লিখে বড় করে বিজ্ঞাপন দেন। তাতে আজকের বাঁচাটুকু, আনন্দের মুহূর্তটুকু ব্যাহত হয়। জরা, ব্যাধি তো অবশ্যম্ভাবী, তাকে আলাদা করে রোজকার চলাফেরার পথে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যা কিছু অমোঘ তা তো এমনি আসবে, আহ্বান না করলেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement