আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র চেহারাটাই হতে পারত অন্যরকম। আবার এর ‘ভাষ্যপাঠ করতে পারতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নয়, অন্য কেউ। ভাগ্যিস তা হয়নি! হ’লে তা এমন সুদূরপ্রসারী প্রভাব-বৈভব সৃষ্টি করতে পারত কি না সংশয় জাগে।
১৯৩১ খৃস্টাব্দে বাসন্তীপূজা আর অন্নপূর্ণাপূজার সন্ধিক্ষণে কলকাতা বেতারে প্রচারিত হয়েছিল ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটি অনুষ্ঠান। বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য, নামান্তরে বাণীকুমার শ্রীশ্রী মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর আখ্যানের ভিত্তিতে ওই চম্পূ বা গদ্যপদ্যময় কাব্যটি রচনা করেছিলেন। পরের বছর এরই অনুসরণে তিনিই রচনা করেন একটি গীতিআলেখ্য। মহাষষ্ঠীর সকালে প্রচারিত সেই অনুষ্ঠানটির তখন কোনও নামকরণ করা হয়নি। ১৯৩৩ খৃস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর এই অনুষ্ঠানটিরই পরিমার্জিত একটি রূপ সম্প্রচারিত হয়। পরের বছর আবার কিছুটা পরিমার্জন করে একই অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় ‘বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরবধ’ নাম দিয়ে। ১৯৩৭ খৃস্টাব্দে অনুষ্ঠানটির নামকরণ হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
বাঁ দিকে বাণীকুমার, ডান দিকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
সেই সূচনা থেকে কত বার যে অনুষ্ঠানটির পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও সংশোধন হয়েছে, বলা কঠিন। স্তোত্র, সঙ্গীত, ভাষ্য— সর্বক্ষেত্রেই এই পরিমার্জন ও সংযোজন ছিল শ্রোতাদের কাছে অনুষ্ঠানটি আরও গ্রহণযোগ্য ও আদরণীয় করে তোলার লক্ষ্যেই। কিন্তু কেমন ছিল সেই প্রথম দিকের এই অনুষ্ঠানটির রূপ? সে কথায় যাওয়ার আগে শিবের গীত যে একটুখানি গাইতেই হয়!
অনুষ্ঠানটির মূল কারিগর বাণীকুমার এবং তাঁর অন্যতম প্রধান দুই সহযোগী, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তো এখন কিংবদন্তি। সহযোগী সঙ্গীতশিল্পী, এমনকি, বাদ্যযন্ত্রীদের কথাও অনেক বই বা পত্রপত্রিকায় মিলবে। কিন্তু আরেক জন নেপথ্যকর্মীর অনলস প্রয়াসের কথা এত দিন অনুচ্চারিতই থেকে গিয়েছে। তিনি কলকাতা বেতারের বিশিষ্ট নাট্যব্যাক্তিত্ব শ্রীধর ভট্টাচার্য। অবশ্য তখনও তিনি নাট্যব্যাক্তিত্ব হিসেবে খ্যাতিমান হননি। কলকাতা বেতারে ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দে তিনি যোগ দিয়েছিলেন এক জন ‘কপিস্ট’ বা প্রতিলিপিকার হিসেবে। নাটকের অভিনেতা তো বটেই, অন্যান্য অনেক অনুষ্ঠানের শিল্পীদের জন্যেও তাঁকে সম্প্রচারের মূল লিপির প্রতিলিপি তৈরি করে দিতে হত। এক এক বারে কার্বন পেপারে চার কপি করে লিখতে হত। ব্যথা হত আঙ্গুলে। ফোটোকপি করার যন্ত্রের ব্যবস্থা তো আর ছিল না সে যুগে। যা হোক, ১৯৪২ খৃস্টাব্দে প্রচারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রচনাটির অন্তত একটি প্রতিলিপি কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে পারেনি শ্রীধর ভট্টাচার্যের পুত্র সনৎ ভট্টাচার্যের সযত্ন সংরক্ষণের দৌলতে। কেমন ছিল সেই রূপ?
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সামনে কলাকুশলীরা ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটির শুরুতেই আমরা যে মঙ্গলশঙ্খধ্বনি শুনি, আগে তা ছিল দেবী চণ্ডীর স্তবটুকুর পরে। বিখ্যাত গায়ক ও লেখক নলিনীকান্ত সরকারের রচনা বলছে, ‘দু’দিন আগে থেকেই প্রচারিত হচ্ছে এই অনুষ্ঠানটির কথা। ষষ্ঠীর দিন ভোরে উঠে শ্রোতারা অপেক্ষা করে আছেন বেতারযন্ত্রটি নিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠানটির ঘোষণা হওয়ামাত্র শাঁখ বেজে উঠল। কলকাতা শহর মন্দ্রিত হয়ে উঠল শঙ্খধ্বনিতে। পূজামন্দির হয়ে উঠল কলকাতা শহর’। শ্রীধর’দার করা প্রতিলিপিতে আছে চণ্ডীস্তবের শেষে ‘গম্ভীর সঙ্গীত— শঙ্খ’। আর তার পরেই ‘কথা’, ‘ভাষ্য’ শব্দটি কিন্তু নির্দেশনায় ব্যবহৃত হয়নি। সূচনার সেই কথা বা ভাষ্যটি ছিল, ‘আজ ভগবতী মহামায়ার বোধন। দিকপ্রান্তে বনে বনান্তে, নীল আকাশে, বাতাসে, স্বর্গে-মর্ত্যে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার পূজা বৈভব ব্যাপ্ত হল। দেবীর আবির্ভাব হবে … সপ্তলোক তাই আনন্দময়। প্রকৃতির উৎসব সঙ্গীতে ত্রিজগতের উল্লাস পরিপূর্ণ হবে। আজ ধরিত্রী আরতি-গীতে মহিমান্বিত করছেন নিখিল চরাচর।… এই অপরিসীম আনন্দযজ্ঞে দেবীর বরণ প্রসন্ন হল। …নটনাথ শিব ভৈরব গানের মালা রচনা করে দেবীর কণ্ঠে বরমাল্য অর্পণ করলেন। বাণীর ভক্তিরসপূর্ণ পূজার কমল শতদল মেলে অম্লান ফুটে উঠুক।…এসেছে শরৎলক্ষ্মী ভুবনের দ্বারে— আলোকদূতী। তাই বেজে উঠেছে আকাশে বাতাসে আলোর বীণা-বেণু-জ্যোতির মঞ্জীরধ্বনি— শুভ্র সুরের আগমনী।’
এই ভাষ্যের পরই ছিল মৃদু শঙ্খবাদনের নির্দেশ এবং পর পর দুটি গান ‘সিংহস্থা শশীশেখরা’ এবং ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। পরবর্তীকালে দেখা গেল, এই দুটি গানের মাঝে রাখা হয়েছে ভাষ্যপাঠ। এই ভাষ্য রচনার ক্ষেত্রেও কাটাছেঁড়া কম হয়নি। তবে মূল সুরটি থেকে গিয়েছে অবিকৃত। কোনও কোনও ভাষ্য ছিল সহজ করে গল্প বলার মতোই। যেমন, “ব্রাহ্মমুহূর্তে যখন মহামুনি সুমেধা মহাশক্তি দুর্গাকে আবাহন করছেন, হৃতঃসর্বস্ব রাজা সুরথ ব্রহ্মর্ষির আশ্রমে এলেন। তিনি বললেন, আজ আমি নিঃস্ব নিঃসম্বল। পথের ভিখারী। আমি রাজ্যহারা। আমি যাদের নিজের সন্তানের মতো পালন করে এসেছি, তারাই আমাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে পথের ধুলিতে আমার অপমানের আসন বিছিয়ে দিয়েছে। দ্বিজবর, আমি কী রূপে আবার আমার রাজ্য, আমার সকল লুপ্ত সম্মান ফিরে পাব? কীসে আমার শক্তি উদ্বুদ্ধ হবে?” ঠিক এর পরেই ভাষ্যপাঠকে যেন আরও একটু নাটকীয় করে তুলতেই রচনায় নির্দেশ রাখা হ’ল, ‘সঙ্গীতে একটি যন্ত্র উচ্চতানে বাজতে থাকবে’। এবং তার মধ্যেই ভাষ্যপাঠ চলতে থাকল, ‘‘ঋষি বললেন মহাশক্তির আরাধনা কর…।’’
রেডিওতে চলছে মহিষাসুরমর্দিনী ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
সঙ্গীত বা সুর সহযোগে ভাষ্যপাঠ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান থেকেই শুরু হয়েছিল। এবং সেটিও হয়েছিল কিছুটা আকস্মিক ভাবেই। সংস্কৃত শ্লোক আর বাংলার তফাত বুঝতে না পেরে উর্দুভাষী মুসলমান বাদকরা বীরেনদা’র কথার সুরে সুর মিলিয়ে বাজনা বাজিয়ে গিয়েছিলেন। এর পর তিনি গদ্যাংশও সুর করে পড়ায় যন্ত্রশিল্পীদের সুরের সঙ্গে অভিনব এক সৃষ্টি হয়েছিল। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা হয়েছিল সেটি সম্প্রচারের মাসখানেক আগে। মহড়া চলেছিল প্রায় এক পক্ষকাল ধরে। কিন্তু জাতপাতের প্রশ্নও যে এই অনুষ্ঠানটিকে ছুঁতে চেয়েছিল, সে কথা ভাবলে এখন বিস্ময় জাগে! সেকালের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল কলকাতা শহরের খ্যাতিমান যন্ত্রশিল্পীদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি অর্কেস্ট্রা। সেই বাদ্যবৃন্দ শিল্পীদের মধ্যে সারেঙ্গি বাজাতেন মুন্সী, চেলো বাজাতেন তাঁর ভাই আলি, হারমোনিয়ামে থাকতেন খুশী মহম্মদ— এমন সব মুসলমান। এঁদের নিয়ে তখন কোনও প্রশ্ন না উঠলেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যেহেতু কায়স্থ, তাঁর মুখে চণ্ডীপাঠ শ্রোতারা মেনে নেবেন কি না, এই প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ।
অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনার সময়ই বীরেন’দা ভাষ্যপাঠে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রতিবছর পুজোর সময় কোথাও ঠাকুরের সামনে বসে তিনি চণ্ডীপাঠ করতেন। তাই এই পাঠে তিনি কিছুটা সড়গড় ছিলেন। অনুষ্ঠান পরিচালক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ও সানন্দে তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। বীরেন’দা কায়স্থ বলে তাঁকে দিয়ে চণ্ডীপাঠ করানো নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তিনি তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘প্রোগ্রাম করবে তাতে আবার বামুন-কায়েত কী হে? আমরা কি মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? এ অনুষ্ঠানের যন্ত্রশিল্পীদের অর্ধেকই তো মুসলমান। তা হলে তো তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণ বাদকদের খুঁজে আনতে হয়!’’ আর বাণীকুমার হেসে বলেছিলেন, ‘‘বটেই তো। ওসব কথা ছেড়ে দিন না। আমি বীরেন ছাড়া কাউকে চণ্ডীপাঠ করতেই দেব না।’’ এঁদের কথাই ছিল সে দিন শেষ কথা। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানে বীরেন’দার ভাষ্যপাঠই তো মহালয়ার ভোরের সঙ্গে সারা দেশবাসীর পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে তাঁর যে কোনও বিকল্প হয় না, তা-ও পরীক্ষিত সত্য ।
প্রসঙ্গত, প্রথম দু’বছর অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল মহাষষ্ঠীর ভোর চারটের ২৪ মিনিট আগে। তার পর অনেকের অফিসে ছুটি না থাকায় এবং পুজোর ব্যস্ততার কারণে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সময়টি নির্দিষ্ট হয়ে যায় মহালয়ার ভোরে। বুধবার যে ভোরে আবার রেডিওয় কান পাতবে বাঙালি।
(লেখক আকাশবাণী ও কলকাতা দূরদর্শনের প্রাক্তন সংবাদ পাঠক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)