অনৈতিকতায় কলুষিত বাঙালি সমাজে কোনও দিন নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি বিদ্যাসাগর। তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষ ছিলেন। “...তিনি নিজের মধ্যে যে এক অকৃত্রিম মনুষ্যত্ব সর্বদাই অনুভব করিতেন, চারিদিকের জনমণ্ডলীর মধ্যে তাহার আভাস দেখিতে পান নাই।” তথাকথিত সভ্য এবং শিক্ষিত বাঙালির কদর্য আচরণে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। জীবনের শেষ ভাগে তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মাঝেমাঝেই কর্মাটাঁড়ে গিয়ে থাকতেন। সেখানে নিরক্ষর সাঁওতালদের স্বাভবচরিত্রে, আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ তিনি বলতেন, “পূর্বে বড় মানুষদের সঙ্গে আলাপ হইলে বড় আনন্দ হইত, কিন্তু এখন তাঁহাদের সহিত আলাপ করিতে প্রবৃত্তি হয় না। সাঁওতালদের সহিত আলাপে আমার প্রীতি।”
অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে বিদ্যাসাগর মাঝেমাঝে অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কোনও নির্জনে স্বাস্থ্যকর স্থানে অবসর যাপনের জন্য একটি স্থায়ী বাসস্থানের অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাই জামতাড়া ও মধুপুরের মধ্যবর্তী কর্মাটাঁড় (বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর) রেল স্টেশনের খুব কাছে বনজঙ্গল ঘেরা শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে বিদ্যাসাগর একটি জরাজীর্ণ বাড়িসমেত চার-পাঁচ বিঘা জমি ক্রয় করেন। ১৮৭১-৭২ সালে সেই বাড়ি ভেঙে তিনি নিজের পছন্দমত একটি বাড়ি তৈরি করেন। বাড়ির নাম ‘নন্দন কানন’। বাড়ির চার পাশের জমিতে বাগান করেছিলেন। নানা রকম ফুল ও ফলের গাছ লাগিয়ে বাগানটিকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য তিনি ও তাঁর নিযুক্ত সহকারী অভিরাম মণ্ডল অনেক পরিশ্রম করেছেন। অভিরাম নিজের স্বভাবগুণেই বিদ্যাসাগরের প্রিয়পাত্র। অভিরামের প্রতি তাঁর বিশ্বাস এতই প্রবল যে, কর্মাটাঁড়ের লোকেদের মাসোহারার টাকা, জামাকাপড় তিনি অভিরামের কাছে পাঠাতেন।
সাঁওতালরা বিদ্যাসাগরের বাগানে মজুরের কাজ করতে আসতেন। সেখানে মজুরির হার যা ছিল, দৈনিক মাথাপিছু দু’আনা, বিদ্যাসাগর তার চেয়ে বেশি হারে মজুরি দিতেন, দৈনিক চার আনা। এই প্রস্তাব মজুরদের কাছে একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হল না, ভাবলেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের সঙ্গে রসিকতা করছেন। অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে বিশ্বাস করানো গেলে তাঁরা সবাই কাজ শুরু করলেন। দুপুরবেলা প্রবল ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হল। বিদ্যাসাগর বার বার তাঁদের কাজ ছেড়ে চলে আসতে বললেন। কিন্তু তাঁরা কর্ণপাত করলেন না। বললেন, পুরো কাজ না করলে তাঁরা পুরো মজুরি পাবেন না। বিদ্যাসাগর আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি মজুরির এক পয়সাও কাটবেন না। তখন তাঁরা কাজ ছেড়ে বাড়ির মধ্যে চলে এলেন। বিদ্যাসাগর প্রত্যেককে পুরো মজুরি দিলেন।
বিদ্যাসাগর হ্যানেম্যানের হোমিয়োপ্যাথি অনুসরণ করে চিকিৎসা করতেন। দীর্ঘকালের অনুসন্ধান, অনুশীলন এবং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে তিনি এক জন দক্ষ চিকিৎসক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যখন কর্মাটাঁড়ে যেতেন, তখন সঙ্গে নিয়ে যেতেন প্রচুর পরিমাণে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ এবং রোগীদের ওষুধ দেওয়ার জন্য অসংখ্য খালি শিশি। বিদ্যাসাগর ভোর থেকে অসুস্থ সাঁওতালদের চিকিৎসা করতেন, পথ্যের জন্য সাবু, বাতাসা, মিছরি ইত্যাদি দিতেন, প্রয়োজন হলে সেবা-শুশ্রূষাও করতেন।
এক বার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লখনউ যাওয়ার পথে কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়েছেন। তখন দুপুরবেলা। দেখেন, বিদ্যাসাগর বাড়িতে নেই। “কিছুক্ষণ পরে দেখি, বিদ্যাসাগর মহাশয় একটা আল-পথে হন্ হন্ করিয়া আসিতেছেন, দর্ দর্ করিয়া ঘাম পড়িতেছে, হাতে একটা পাথরের বাটি।... বলিলেন— ওরে, খানিকক্ষণ আগে একটা সাঁওতালনী আসিয়াছিল; সে বলিল— ও বিদ্যেসাগর, আমার ছেলেটার নাক দিয়ে হু হু ক’রে রক্ত পড়ছে, তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস। তাই আমি একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ এই বাটি ক’রে নিয়ে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য, দেখলাম এক ডোজ ওষুধে তার রক্ত পড়া বন্ধ হইয়া গেল। ইহারা তো মেলা ওষুধ খায় না, অল্প ওষুধেই উপকার হয়, কলকাতার লোকের ওষুধ খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়িয়া গিয়াছে, মেলা ওষুধ না দিলে উপকার হয় না।”
এক দিন সকালবেলা এক জন মেথর কাঁদতে কাঁদতে এসে বললেন, তাঁর বৌয়ের কলেরা হয়েছে, এখনই চিকিৎসা দরকার, না হলে সে বাঁচবে না। বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ রোগীর চিকিৎসা করতে চললেন। সারা দিন রোগিণীর শয্যার পাশে বসে ওষুধ দিলেন, অবস্থার উন্নতি হলে বাড়ি ফিরলেন।
১৯৮৩ সালে বিদ্যাসাগরের তৃতীয় জামাতা (বিনোদিনী দেবীর স্বামী) সূর্যকুমার অধিকারীর পৌত্র সন্তোষকুমার কর্মাটাঁড়ে গিয়ে অভিরামের নাতি নাথুরামের কাছে একটি ঘটনার কথা শোনেন। এক রাতে বারোটার পর অভিরাম দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে লাঠি হাতে বেরিয়ে এসে দেখে, বিদ্যাসাগর এক ক্রন্দনরত মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর স্বামী কলেরায় আক্রান্ত। অভিরাম দেখলেন, বিদ্যাসাগর ওষুধের বাক্স হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে ওঁর সঙ্গে হাঁটতে শুরু করেছেন। অভিরামও সঙ্গ নিল। বিদ্যাসাগর রোগীর বাড়ি পৌঁছে তাঁর শয্যার পাশে বসে চিকিৎসা আরম্ভ করলেন।
দূরবর্তী গ্রাম থেকে যে সব রোগী চিকিৎসার জন্য বিদ্যাসাগরের কাছে আসতেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার জন্য কর্মাটাঁড়ের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে দুই কামরার একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন এই মহাপ্রাণ মানুষটি।
জীবনের শেষ চার-পাঁচ বছর বিদ্যাসাগর কর্মাটাঁড়ে যাননি। ১৮৯০ সালের এপ্রিল মাসে তাঁর পেটের রোগ বাড়তে থাকে। ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে চন্দননগরের ফরাসডাঙায় গঙ্গাতীরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাস করতে লাগলেন, মাঝেমাঝে কলকাতায় গিয়ে মেট্রোপলিটান স্কুল, মেট্রোপলিটান কলেজ এবং অন্যান্য বিষয় তত্ত্বাবধান করে আবার ফরাসডাঙায় ফিরে যেতেন। কিন্তু মার্চ ১৮৯১ মাসে বুঝলেন, শরীর ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অবশেষে মে-জুন মাসে কলকাতায় বাদুড়বাগানের বাড়িতে ফিরে এলেন। অ্যালোপ্যাথি, হোমিয়োপ্যাথি, হাকিমি সব চিকিৎসাই হল। ২৯ জুলাই রাত দুটো আঠারো মিনিটে তাঁর প্রয়াণ হল।