শিল্পকলার আলোচনায় যে দুটো শব্দ প্রায়ই ফিরে আসে তা হল আধুনিক আর সাম্প্রতিক, ইংরেজিতে বললে ‘মডার্ন’ আর ‘কনটেম্পোরারি’। এদের প্রথম শব্দটা যদি কালের বিচারে এগিয়ে, দ্বিতীয়টি তবে ছুঁয়ে থাকে বর্তমান সময়পট। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় অনেকটা সেই ‘স্টাইল’ আর ‘ফ্যাশান’-এর মতো। একটা হচ্ছে বিশিষ্টতা, শৈলী। গুণগত বিচারে তার স্থায়ী আসন। আর অন্যটার পাকা ঠিকানা নেই, সময়ের সঙ্গে সে পাল্টে যায়। আজ হইচই বাধলেও কাল হয়তো বিস্মৃতির আড়ালে। কিন্তু একখানা ছবি বা কোনও চিত্রকরের কাজের বিচার কোন পটভূমিকায় করা প্রয়োজন— তিনি যদি জন্মগ্রহণ করে থাকেন সার্ধশতবর্ষ আগে? তখন সেই শিল্পীর জীবন ও কাজকে
ফিরে দেখতে কোন জিনিসটি আমাদের ভাবনার মূল কেন্দ্র হয়ে উঠবে? ব্যক্তিজীবনের কথা নাহয় বাদ দেওয়া গেল, আঁকা ছবিগুলি কি তাঁর সময়ের চালচিত্রে রেখে বিচার করব, না কি বর্তমান ‘আর্ট-সিনারিয়ো’য় মেলে ধরে তাদের যাচাই করে নেওয়া জরুরি? প্রশ্নগুলো তেমন সহজ নয়, তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে যদি সেই শিল্পীর নাম হয় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ এমন একটি নাম, যা মুহূর্তে দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। এক মহান শিল্পী হিসেবেই নয়— মেধা, আভিজাত্য ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের এমন আশ্চর্য সমন্বয় ভারতীয় কলাশিল্পের ইতিহাসে আর পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তবে, মনে হতে পারে, শিল্পাচার্যের আখ্যায় তাঁকে ভূষিত করার কারণগুলি কী? সে ক্ষেত্রে তাঁর জীবনের দিকে এক বার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেওয়া জরুরি। দেখে নেওয়া প্রয়োজন, শিল্পীর জীবনের রেখচিত্র কী ভাবে বাঁক নিয়েছে, এগিয়েছে।
আমরা জানি, অবনীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে সাহেব শিক্ষকের কাছে বিলিতি চিত্রকলার পাঠ নিয়েছেন। তাঁর ছবির ভাবনায় প্রথম দিক বদল স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। সেই পর্বে, যখন আমাদের দৃষ্টি পড়েছে দেশীয় ভান্ডারের দিকে। আলপনা, পটচিত্র, পটের গান, বিভিন্ন লোকগাথা, মেয়েলি ছড়া ইত্যাদির অন্বেষণে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ সকলেই গভীর ভাবে ব্যাপৃত হয়েছেন। তখনই একটি মিনিয়েচার ছবির অ্যালবাম ও একগুচ্ছ আইরিশ মেলোডির ছবি অবনীন্দ্রনাথের চোখ খুলে দিয়েছিল। সেই চিত্রমালা শিল্পীর মনে উস্কে দিয়েছে চিন্তার নবতর রসদ, শুরু হয়েছে নতুন আঙ্গিক ও বিষয় অবলম্বনে কৃষ্ণলীলা ছবি সিরিজ়— যা তাঁর চিত্রীপর্বের প্রথম বাঁক। ইতিমধ্যে ই বি হ্যাভেলের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব অবনীন্দ্রনাথের জীবনে অন্যতম ধাপ। পরবর্তী কালে ভগিনী নিবেদিতা, কাকুজ়ো ওকাকুরা, আনন্দ কুমারস্বামীর সঙ্গে পরিচয় তাঁর শিল্পীসত্তার আর একটি দিক উন্মোচন করেছে। ১৯০২ নাগাদ দু’জন জাপানি শিল্পী টাইক্কান ও হিশিদা সুনসা জোড়াসাঁকোয় এলে ছবির টেকনিক বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকে। এর মাঝে মিনিয়েচার শৈলীতে তেলরঙে আঁকা অবনীন্দ্রনাথের ছবি দ্য পাসিং অব শাহজাহান দিল্লির প্রদর্শনীতে পুরস্কৃত হলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে পরিচিত হয়েছেন। সে ছবিও তাঁর চিত্রের এক রকম পরীক্ষা বলতে হয়। এখানে মিনিয়েচার ছবির নিজস্ব স্টাইলকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তৈলচিত্রের আধারে।
তবে এ সব ছাপিয়ে স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিকায় ভারতমাতা ছবি তাঁকে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। অবনীন্দ্র প্রবর্তিত ওয়াশ টেকনিকের প্রথম সার্থক ছবি হিসেবেও ভারতমাতা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে, যেখানে জাপানি শৈলীর প্রভাব সুস্পষ্ট রূপে প্রতিভাত। দেবীপ্রতিমার মতো চতুর্হস্তা সন্ন্যাসিনীর সেই স্থির অচঞ্চল মূর্তি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটে ভারতবাসীর মনে যে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে, তার তুলনা নেই। তবে সেই পর্বে আর একটি বিখ্যাত ছবি গণেশজননী উঠে এসেছে বিতর্কের কেন্দ্রে। তা বুঝতে ছবির দিকে নজর দিতে হবে। ছবিতে দেখি, ঘাগরা পরিহিত রাজস্থানি রমণীর আদলে দেবী দুর্গা শিশু গণেশকে তুলে ধরে গাছের ডাল থেকে কচি পাতা খাওয়াচ্ছেন।
প্রবাসী-তে এ ছবি প্রকাশের পর যে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তার একটুখানি আঁচ নেওয়া যাক। সাহিত্য পত্রিকায় সুরেশ সমাজপতির বক্তব্য: ‘শ্রীযুত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গণেশ জননী”র চিত্রখানি দেখিয়া আমরা চমকিত হইয়াছি। ঘাঘরা-পরা গণেশ-জননী শিশু গণেশকে তুলিয়া ধরিয়াছেন, আর লালটুকটুকে গণেশ শুঁড়ে গাছের ডাল জড়াইয়া ধরিয়া “পালা” ভক্ষণ করিবার চেষ্টায় মসগুল।... দেবতা গণেশের জন্য আমাদের দুঃখ নাই, কিন্তু যে সকল চিত্রকর-গণেশ তুলিকা-শুন্ডে জড়াইয়া ধরিয়া আমাদের প্রাচীন পৌরাণিকী কল্পনাগুলিকে পদদলিত করিতেছেন, তাঁহাদের কি বলিব? এমনতর উদ্ভট, অদ্ভূত, হাস্যোদ্দীপক পটকে “ভারতীয় চিত্রকলা পদ্ধতি”র আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিতে না পারিলে যদি চা’র পেয়ালায় তুমুল তরঙ্গ উঠে, তাহা হইলে আমরা সম্পূর্ণ নাচার।’ অবনীন্দ্রনাথ কম নিন্দিত হননি। কেবল গণেশজননী নয়, এর ঠিক আগে বুদ্ধ ও সুজাতা ছবি নিয়েও সমাজপতি মহাশয়ের কাছে তিনি কম নিন্দিত হননি। সেখানেও বলা হয়েছে, ‘সুজাতার পাণিদ্বয় যেভাবে বুদ্ধদেবের দিকে অগ্রসর হইতেছে, তাহা দেখিয়া মনে হয়, বুদ্ধদেব যদি তরুমূলে উপবেশন না করিয়া উচ্চ তরুশাখায় সমাসীন থাকিতেন, সেখানেও সুজাতার কর-বংশদণ্ডদ্বয় তাঁহার সমুখে পায়সপাত্র ধরিতে পারিত।... স্বাভাবিকতার শ্রাদ্ধই প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলা পদ্ধতির একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে আমরা নাচার।’ পত্রিকার আলোচনা থেকেই স্পষ্ট, সেই পর্বে আমাদের শিল্পদৃষ্টি লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব আর্ট-এর শিক্ষাদর্শে কতটা আবৃত ছিল। এর বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত হেনেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।
সমালোচনার প্রেক্ষিতে মনে রাখতে হয়, অবনীন্দ্রনাথের ছবি তথা বেঙ্গল স্কুলের উন্মেষ না ঘটলে আমাদের শিল্পের অভিমুখ এগোত কোন দিকে? তখন রবি বর্মার যুগ, ওলিয়োগ্রাফের মাধ্যমে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর আঁকা পৌরাণিক বিষয়ের ছবি। ভারতীয় পুরাণ অবলম্বনে চিত্রিত হওয়ায় তা ক্রমে হয়ে উঠেছিল ভারতীয় চিত্র-আদর্শের অন্যতম নিদর্শন। কিন্তু তাঁর ছবি ভারতীয় পুরাণকেন্দ্রিক হলেও, ছবির আঙ্গিক ও পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ পশ্চিমের আদর্শে তৈরি। ইউরোপীয় বাস্তবানুগ ছবির আলো-ছায়া ঘেরা সে ছবিকে কেবল বিষয়ের নিরিখে ভারতীয় আখ্যায় ভূষিত করা যায় না। এর বিপরীতে অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্যদের উত্থান আমাদের শিল্পকলায় প্রাচ্যের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে এনেছে। এই কারণেই কি অবনীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে স্মরণীয়, জাতীয়তাবাদের পটভূমিকায় এক নতুন চিত্রপথের প্রবর্তক হিসেবে?
আজ সে কথাই নতুন করে ভাবার। অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন মুক্তমনা এক শিল্পব্যক্তিত্ব। কোনও বিশেষ অভিমুখে নয়, বারংবার তাঁর ছবির বাঁক বদল ঘটেছে। নিজের কাজ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন আজীবন। ওমর খৈয়াম থেকে আরব্য রজনী চিত্রমালার যাত্রাপথ বিবর্তিত হয়েছে একাধিক বার। কখনও প্রতিকৃতি অঙ্কনের অভিজ্ঞতাকে রূপান্তরিত করেছেন মুখোশ চিত্রসিরিজ়ের আশ্চর্য নৈপুণ্যে। আবার পুরী বা সাজাদপুরের নিসর্গ হয়ে উঠেছে মায়াবী আলোর রূপকথা। শিল্পীর আবিষ্কৃত চিত্ররীতি ওয়াশ টেকনিকও যেন তাঁর পরীক্ষাগারে তৈরি বিচিত্র সালোকসংশ্লেষের বিক্রিয়া। সেখানে প্রধান ভর ভারতীয় মিনিয়েচার ছবির গায়ে থাকলেও, মিশেছে জাপানি টেকনিক ও ইউরোপীয় ঘরানার জলরঙের স্বচ্ছতা, যা কেবল দেশের সীমানায় বাঁধা পড়ে না। আবার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইউরোপীয় শিল্পের বিমূর্ত রসের সবটুকুও গ্রহণ করেননি তিনি, তাদের বিশুদ্ধ রূপনির্মাণ অপেক্ষা বহু উপাদানে মিশ্রিত শিল্পসৃষ্টিই তাঁর বরাবরের লক্ষ্য ছিল।
কুমারস্বামী, হ্যাভেল, নিবেদিতা যখন কেবল জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিতে তাঁকে তুলে ধরতে চান। কিন্তু তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষের আবহে শুধু সেই তকমায় তাঁর পরিচয় দিতে আমাদের দ্বিধা হয়। একেবারে শেষ বেলার ‘কুটুম কাটাম’ নিয়ে খেলার ছলে যে আধুনিক ভাস্কর্যের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তিনি, বাতিল জিনিস দিয়ে গড়া পিকাসোর ভাস্কর্যের সঙ্গেও কি তার তুলনা করা চলে না?
ভূতপূর্ব কিউরেটর, ‘নন্দন’, কলা ভবন, বিশ্বভারতী