যারা লাভের মুখ দেখছে
Share Market

অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, কিন্তু শেয়ার বাজার বাড়ছে কেন?

লক্ষণীয়, ভারতীয় অর্থনীতির পুনরুত্থান নিয়ে যাদের এখন কম নিরাশাবাদী মনে হচ্ছে, তারাও কিন্তু চলতি বছরে জাতীয় আয় যে কমে যাবে, এটা নিয়ে একমত।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:২০
Share:

কোভিড সঙ্কটের ফলে ভারতীয় অর্থনীতির যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে ইদানীং অনেকেই সুড়ঙ্গের শেষ দেখতে পাচ্ছেন। দেশ জুড়ে দৈনিক সংক্রমণের হার যেমন কমছে, তেমনই দেশি-বিদেশি একাধিক টিকা বাজারে চলে আসার সম্ভাবনাও প্রবল হচ্ছে। এই অবস্থায় বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা, চলতি বছরে ভারতের জাতীয় আয় যতটা কমে যাবে বলেছিল, এখন মত বদলে বলছে ততটা কমবে না। যেমন মুডিজ় বিনিয়োগ পরিষেবা আগে পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে ভারতের জাতীয় আয় ১১.৫% কমে যাবে। এখন তারা বলছে যে, এই বছরে জাতীয় আয় কমবে ১০.৬%। একই ভাবে গোল্ডম্যান স্যাক্‌‌স ভারতীয় আয়হ্রাসের পূর্বাভাস ১৪.৮% থেকে কমিয়ে ১০.৩% করেছে।

Advertisement

লক্ষণীয়, ভারতীয় অর্থনীতির পুনরুত্থান নিয়ে যাদের এখন কম নিরাশাবাদী মনে হচ্ছে, তারাও কিন্তু চলতি বছরে জাতীয় আয় যে কমে যাবে, এটা নিয়ে একমত। সেই তালিকায় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বিভিন্ন রেটিং সংস্থা, সবই আছে। এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কোভিড-এর জন্য দীর্ঘ দিন ব্যবসার প্রভূত ক্ষতি হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থা এখনও ফেরেনি, অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে তার ছায়া তো পড়বেই। আশ্চর্য এটাই যে, জাতীয় অর্থনীতির এই দুর্দিনেও দেশের শেয়ার বাজারে অভূতপূর্ব ঊর্ধ্বগতি। মন্দার পরিবেশ সত্ত্বেও, শেয়ার বাজারের দুটো প্রধান সূচক, বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সেনসেক্স এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের নিফটি, ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

তা হলে ধরে নিতে হয়, শেয়ার বাজারের সঙ্গে প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থার কোনও সম্পর্কই নেই। কিন্তু, তা-ই বা কী করে হবে? বিনিয়োগকারী যখন শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন, তখন তিনি সংস্থার ভবিষ্যৎ লাভের সম্ভাবনার দিকে নজর রাখছেন। সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির পুনরুত্থান না ঘটলে সংস্থা লাভ করবে কী করে? আর সংস্থার লাভ করার সম্ভাবনা তৈরি না হলে, শেয়ারের চাহিদা এবং দামই বা বেড়ে চলবে কী করে? এটা একটা ধাঁধা— এক দিকে জাতীয় আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা, অন্য দিকে শেয়ার বাজারে নিরবচ্ছিন্ন আশাবাদ। বস্তুত, এই ধাঁধার ভিতরে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গভীরতর একটা প্রবণতা লুকিয়ে রয়েছে।

Advertisement

কেউ বলতে পারেন, শেয়ার বাজার দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্থার মূল্যায়ন করে। দীর্ঘমেয়াদে বা এমনকি মধ্যমেয়াদেও সংস্থার লাভের সম্ভাবনা থাকলে শেয়ার বাজার তাকে প্রসন্ন দৃষ্টিতেই দেখবে। দেশ জুড়ে কোভিডের সংক্রমণ যত কমছে, যত বাড়ছে শক্তিশালী টিকা বাজারে আসার সম্ভাবনা, ততই সংস্থাগুলোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর হচ্ছে। শেয়ার বাজারের বর্তমান চাঙ্গা ভাব সেই উজ্জ্বল প্রত্যাশার প্রতিফলন।

এই ব্যাখ্যা দিয়ে কিন্তু শেয়ার বাজারের ঊর্ধ্বগতি পুরোপুরি বোঝা যাবে না। প্রথমত, শেয়ার বাজার শুধু দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার দিকে দৃষ্টিপাত করে, এটা ঠিক নয়। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শেয়ার বাজারে বর্তমানের ছোট-ছোট ঘটনাও ভবিষ্যৎ মূল্যায়নকে প্রভাবিত করছে— কোভিড পরিস্থিতির অনিশ্চয়তা তো অনেক বড় ঘটনা। দ্বিতীয়ত, পেশাদারি আর্থিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষের শেষেও কিন্তু জাতীয় আয় ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের জাতীয় আয়ের তুলনায় খুব বেশি বাড়বে না, সম্ভবত তার নীচেই থাকবে। যেমন, মুডিজ় ভবিষ্যদ্বাণী করছে যে, ২০২১-২২’এ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার হবে ১০.৮%। এই সংস্থাটিই আবার আশঙ্কা করছে যে, ২০২০-২১’এ জাতীয় আয় ১০.৬% কমে যাবে। কোনও সংখ্যা প্রথমে ১০.৬% কমে গিয়ে সেই কমে যাওয়া সংখ্যাটা যদি আবার ১০.৮% বৃদ্ধি পায়, তা হলে, পাটিগণিতের নিয়মে, সেটি আগের মানে পৌঁছতে পারে না। ধরা যাক, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে জাতীয় আয় ছিল ১০০। মুডিজ়-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০২০-২১’এ সেটা ১০.৬% কমে গিয়ে হল ৮৯.৪। এই কমে যাওয়া সংখ্যাটা ২০২১-২২’এ ১০.৮% বেড়ে গিয়ে হল ৯৯.০৫, অর্থাৎ ১০০-র কম। ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষের মধ্যেও যদি ভারতীয় অর্থনীতি তেমন ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, তা হলে কী দেখে শেয়ার বাজার আশাবাদী হচ্ছে?

কেউ কেউ আবার বলছেন, শেয়ার বাজার তেজি হওয়ার একমাত্র কারণ ভারতীয় শেয়ার বাজারে বিদেশি পুঁজির ব্যাপক প্রবেশ। কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। ভারতীয় শেয়ার বাজার তেজি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণ অবশ্যই বিদেশি লগ্নি। কিন্তু, বিদেশিরা বিনিয়োগ করছেন কেন? বিশেষ করে যখন ভারতীয় অর্থনীতি সঙ্কোচনের সম্ভাবনা এতটাই প্রবল। গত অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার যে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক প্রকাশ করেছে, তাতে ২০২০ সালের অনুমিত আয়হ্রাসের নিরিখে বড় দেশগুলোর মধ্যে স্পেন এবং ইটালির পরেই ভারত জায়গা করে নিয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক আভাস দিচ্ছে, ২০২০ সালে স্পেনের জাতীয় আয় কমবে ১২.৮%, ইটালির ১০.৬%, ভারতের ১০.৩%। তবু বিদেশিরা ভারতীয় শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করছেন কেন?

আসল রহস্যটা সেনসেক্স বা নিফটি নামক সূচকগুলির নির্মাণ-প্রণালীর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। মনে রাখতে হবে, সেনসেক্স বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সবচেয়ে দামি ত্রিশটা এবং নিফটি ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের শ্রেষ্ঠ পঞ্চাশটা সংস্থার শেয়ারের গড় মূল্যায়ন। গত এক বছরে সেনসেক্স ৯.৩৯% বৃদ্ধি পেয়েছে, নিফটি বৃদ্ধি পেয়েছে ৮.৬৯%। এর মানে হল, এই কোভিড সঙ্কটের মধ্যেও কিছু সংস্থা, বলা যায় সবচেয়ে ভাল সংস্থাগুলো, ভাল ফল করছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মূলত এই ভাল শেয়ারগুলি নিয়েই বেচা-কেনা করছেন।

কিন্তু নিফটি বা সেনসেক্স যে চিত্রটা তুলে ধরছে, সেটা একপেশে। যেগুলো খুব ভাল সংস্থা, শুধু তাদের কথাই বলছে; এর বাইরে কী হচ্ছে, সেটা নিফটি বা সেনসেক্স-এর গতিপ্রকৃতি দেখে বোঝা যাবে না। ‘নিফটি ৫০০’ বলে আর একটি সূচক আছে, যেখানে পঞ্চাশটার বদলে পাঁচশোটা সংস্থার শেয়ারের গড় মূল্য নেওয়া হচ্ছে। গত এক বছরে সেই সূচক ৩২.৮১% কমে গিয়েছে। অর্থাৎ, কোভিড সঙ্কটের সময় বেশির ভাগ সংস্থাই ভাল করেনি; কিছু শীর্ষস্থানীয় সংস্থা তাদের লাভজনক অবস্থাটা বজায় রেখেছে। আবার, তথ্যপ্রযুক্তির মতো কিছু কিছু ক্ষেত্র কোভিডের কারণেই অস্বাভাবিক লাভের মুখ দেখেছে। ‘নিফটি-আইটি’ নামক সূচকটি গত এক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪.৭৫%। উল্টো দিকে, রিয়্যাল এস্টেটের সূচক ‘নিফটি-রিয়্যাল্টি’র এক বছরে ৪৩.৪২% পতন ঘটেছে। এর বাইরে বহু সংস্থা আছে, যারা শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত নয়; তারও বাইরে রয়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অসংখ্য ছোট ছোট সংস্থা। কোভিড সঙ্কটের ফলে এদের অধিকাংশের অবস্থাই শোচনীয়। অনেকেই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে শোধ দিতে পারছে না। ফলে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রটি বিশেষ ভাবে মার খেয়েছে। ‘নিফটি-ব্যাঙ্ক’ নামক সূচকটি এক বছরে নেমে গেছে ৯.৫%।

দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের এই সার্বিক ছবি জাতীয় আয় কমে যাওয়া নিয়ে আর্থিক সংস্থাগুলির অনুমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। শেয়ার বাজারের যে কাহিনি সংবাদমাধ্যমে প্রচার পাচ্ছে, সেটা কতিপয় সফল সংস্থার গল্প; এর বাইরে যে অপ্রফুল্ল চিত্রটা রয়েছে, নিফটি বা সেনসেক্স দিয়ে সেটা ধরা যাচ্ছে না। কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখলে, এর থেকে ভারতীয় অর্থনীতির আর একটা গভীরতর প্রবণতা উঠে আসবে। বোঝা যাবে, যে ক্রমবর্ধমান অসাম্য আমাদের সমাজকে বেশ কিছু দিন ধরে গ্রাস করে ফেলছে, কোভিড সঙ্কটের ফলে সেই অসাম্য আরও বেড়েছে। কোভিড সঙ্কট থেকে আর্থিক ভাবে শক্তিশালীরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, কেউ কেউ এর থেকে লাভবানও হয়েছে। তুলনায়, যারা আর্থিক ভাবে দুর্বল, তাদের অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে পঞ্চাশটি সংস্থার সাফল্য এবং পাঁচশোটি সংস্থার ব্যর্থতা মোটের উপর এই বার্তাই বহন করছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement