মাথায় আছে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন, এ দিকে বিগত ত্রৈমাসিকে ক্রমক্ষয়িষ্ণু জিডিপি আরও নিম্নমুখী হয়ে ৪.৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে, যা এই অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকের তুলনায় ০.৫ শতাংশ কম এবং বিগত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন (যেখানে আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের জিডিপি ৭.৯ শতাংশ)। এটি গত অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২.৬ শতাংশ পতন (গত বছর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপি ৭.১ শতাংশ ছিল)।
বর্তমান অর্থনীতির স্তিমিত ঝিমুনি ভাব অবরোহণের নিম্নভূমিতে বিচরণ করছে, সেখান থেকে আরোহণের জন্য প্রয়োজন সদর্থক পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন। বিপন্ন পরিবেশ ও জলবায়ু সঙ্কটের বর্তমান যুগে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে নতুন শিল্পস্থাপনের মাধ্যমে অর্থনীতির এই উচ্চাভিলাষী বৃদ্ধি অর্জন যে ভীষণই চ্যালেঞ্জিং ও কষ্টকল্পিত লক্ষ্য, এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। বিমুদ্রাকরণের পর কালো টাকা উদ্ধারের যে স্বপ্নের ফানুস ওড়ানো হয়েছিল, প্রচারের ঢক্কানিনাদে ভেসে গিয়ে সেই উড়ানের পথ চেয়ে দেশের জনগণ সমস্ত কষ্ট ও ভোগান্তিকে সহ্য করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। স্বপ্নের সেই ফানুস অচিরেই চুপসে গিয়ে ভূপতিত হয়েছে। বিদেশি ব্যাংকে গচ্ছিত লক্ষ লক্ষ কোটি কালো টাকা ফিরে আসেনি, যেটুকু পুনরুদ্ধার করা গিয়েছে তা ছিল অনেকটা পর্বতের মূষিক প্রসবের ন্যায়। ফলত নাগরিকদের পনেরো লাখের স্বপ্নও থেকে গিয়েছে অধরা। অর্থনীতির সম্বুকগতি, অভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদন তলানিতে, নতুন লগ্নি নেই, বিভিন্ন সংস্থায় কর্মী ছাটাই, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, বাজারে গাড়ি ছাড়াও অন্য ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে চাহিদার অভাব, পেঁয়াজের অগ্নিমূল্য, বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্বের হার সর্বাধিক, নতুন শিল্পস্থাপনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগে শিল্পপতিদের অনীহা, রফতানিতে ভাটা এগুলো তো প্রত্যেকটিই সর্বৈবই সত্য। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের মতে এগুলো আসলে মন্দাক্রান্ত অর্থনীতির বেহাল দশার প্রতিফলিত চিত্র। বেহাল অর্থনীতিকে খাদ থেকে তুলে উত্তরণের পথে দিশা দেখানোর ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ কবে সুফল এনে দেবে, তা হয়তো সময়ই বলবে।
মেঘলা আকাশ কি আরও নিকষ কালো মেঘে ধুম্রাচ্ছন্ন হবে, নাকি মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ধীরে ধীরে সরে গিয়ে সূর্যের দেখা মিলবে তা হয়তো সময়ই জানান দেবে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ জানিয়েছেন, পাঁচ বছরে দেশের পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ১০৫ লক্ষ কোটি টাকা প্রকল্পের রূপরেখা ঘোষণা করেছেন, যা অর্থনীতির ঝিমুনি দশা থেকে উত্তরণের পথে অনুঘটকের কাজ করবে।
নাকি টি-টোয়েন্টি শুরুর প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে জনগণের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে চমক দেখানোর প্রয়াসের মাধ্যমেই আবদ্ধ থাকবে?
তবে এটাও ঠিক যে অর্থনীতি সবসময়ই সুউচ্চ গতিধারা বজায় রেখে একই ভাবে সরলরৈখিক পথে চলবে সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কারণ অর্থনীতিও চলে কিছুটা ছান্দিক গতিতে অনুসারিত হয়ে আরোহণ অবরোহণের গ্রাফ মেনে। রাতের পরে যেমন দিন আসে ঠিক তেমনই মেঘলা আকাশ কেটে প্রতিভাত হয় সূর্য্যের দীপ্তিমানতা, এটাই জগতের নিয়ম। আর এটাও সত্য যে, বিশ্ব জুড়েই অর্থনীতির একটা ঝিমুনি ভাব চলছে, তার আঁচ এসে পড়বে না ভারতের গায়ে, এ কেমন কথা? আর মন্দা না আসতেই মন্দা মন্দা বলে বেশি লাফালাফি করলেও বিপদ, তাতে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়। কারণ মানুষের মধ্যে তখন খরচ বাঁচানোর প্রবণতা বেশি করে তৈরি হয়, ফলে বিভিন্ন দ্রব্যপণ্যের চাহিদার সঙ্কট আরও প্রকট হয়ে ওঠে, বাজারে অর্থের জোগানও কমে আসে।
অনেকে বলছেন দেশের এই সব মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে, ঘোরানোর জন্যই নাকি তড়িঘড়ি জাতীয় নাগরিকত্ব আইনের প্রবর্তন। প্রতিবেশী দেশ থেকে ক্রমাগত অবৈধ অনুপ্রবেশের ফলে আমাদের দেশের জনসংখ্যার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির পরিণাম যে রাজ্য তথা জাতীয় অর্থনীতির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, এ কথা বুঝতে অর্থনীতির ছাত্র হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন নেই। অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে তা দেশের উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে বিশেষ অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং অনুপ্রবেশ বন্ধ হোক এটা যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই চাইবে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে জাতীয় নাগরিকত্ব আইন প্রবর্তন অবশ্যই এক সাধু উদ্যোগ। কারণ একটা দেশের নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে পাওয়া যাবে নাগরিকত্বের শংসাপত্র। আধারকে আঁধারে রেখে বা এপিককে দূরে সরিয়ে (যে এপিকের সাহায্যেই দেশের পরিচালকগণ নির্বাচিত হয়েছেন), নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে আসলে কোনও প্রামাণ্য নথি নাগরিকত্ব বিচার্য্যের মাপকাঠি হিসেবে অনুসৃত হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা অব্যাহত। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা আসতেই থাকবে আর দেশের জনসংখ্যা বাড়াতেই থাকবে এটা কখনও দীর্ঘদিন চলতে পারে না। সুতরাং নাগরিকত্বের দেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ের একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক থাকা দরকার। নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে সেই নির্দিষ্ট কাট অফ তারিখ ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। অর্থাৎ এই সময়কালের মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষরা যাঁরা ওই সকল দেশে সংখ্যালঘু তাঁরা শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং নতুন আইন তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথকে সুগম করবে, একথা নিশ্চিত। কিন্তু এই তালিকায় বাদ পড়লেন মুসলিমরা। তাঁদের মনে স্বাভাবিক ভাবেই আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হয়েছে এই ভেবে যে, শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীর এই বিভেদরেখার জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথকে দুর্গম
করে তুলবে।
ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান এবং নানা ধর্মের মানুষের মিলনক্ষেত্র ভারত। ভারত দীক্ষিত বহুত্ববাদের মূল মন্ত্রে, সেই বহুত্ববাদের সুদীর্ঘ অতীতের বহতা ধারার পরম্পরাই ভবিষ্যতের পাথেয় হওয়া উচিত। সংবিধানের আর্টিকেল ১৪-য় সাম্যের অধিকারের কথা বর্ণিত আছে, অর্থাৎ আইনের চোখে সমস্ত ধর্মের মানুষেরই থাকবে সমান অধিকার। সংবিধানের এই ধারাকে কোনও শাসক কি লঙ্ঘন করতে পারেন? সুতরাং, মুসলিমদের দাবি মোটেই অসঙ্গত নয়। নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভাজন মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ফলে সিএএ (Citizenship Amendment Act)-এর বিরুদ্ধমত থাকাটাও স্বাভাবিক।
সুতরাং এই আইনের বিরুদ্ধাচরণের নৈতিক অধিকার সকলের আছে। কিন্তু সেই প্রতিবাদ-আন্দোলন গণতান্ত্রিক পরিসীমায় মধ্যে আবদ্ধ থাকবে এটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশই প্রতিবাদ-আন্দোলনের নামে জাতীয় সম্পত্তি পুড়িয়ে তছনছ করে যে হিংসাত্মক ধ্বংসলীলার চিত্র প্রত্যক্ষ কর দেশবাসী তা কোনও মতেই সমর্থনযোগ্য নয়। মনে রাখা দরকার যে কোনও হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাকে হ্রাস করে। যখন এনআরসি ও সিএএ-এর প্রশ্নে বিক্ষোভের আগুন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি থেকে ক্রমান্বয়ে সারা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়, তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখে দিল্লির জনসভা থেকে দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকেই নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বস্তিসূচক বক্তব্য শোনা গিয়েছে। কিন্তু ইতিপূর্বে একাধিক জনসভায় সারা দেশে এনআরসি প্রয়োগের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অনড় মনোভাবের নাছোড় হুংকার, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। হিন্দুয়ানির উগ্রতা ধর্মনিরপেক্ষতার বহতা ধারার ঐতিহ্যেকে প্রলম্বিত করে। সে কথা ভুললে চলবে না। যেমন ভোলা উচিত নয়, দেশের বর্তমান অর্থনীতির দুর্দশার কথাও।
লেখক শক্তিনগর হাইস্কুলের শিক্ষক