economy

দ্বিতীয় ঢেউয়ের আর্থিক অভিঘাত আরও কঠিন, চোকাতে হবে বেপরোয়া আচরণের দাম

রাজ্যেও ভোটের মধ্যে যখন প্রচার থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, আমরা তা আমরা গ্রাহ্য করিনি।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২১ ১৯:৪৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

চাইলে হয়ত পারতাম এই মৃত্যুর মিছিলকে ঠেকাতে। যদি না আপদ বিদায় হয়েছে ঘোষণা করে কোভিড বিধিকেই জলাঞ্জলি দিতাম। তার মূল্য কিন্তু এ বার সাধারণ নাগরিককেই চোকাতে হবে। ধনে ও প্রাণে মরে। তথ্য অন্তত তাই বলছে।

Advertisement

বিগত দুই সপ্তাহে দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ লক্ষ ছাড়িয়েছে। সোমবারের হিসাবে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯৯৮। মৃত ৩ হাজার ৪৪০। সংবাদপত্রে বা টিভির পর্দায় যখন এই সংখ্যা দেখছি তখন তা অনেকের কাছেই শুধু পরিসংখ্যান। এতে যা বলা নেই তা হল এঁদের মধ্যে কতজন বিনা চিকিত্সায় রয়েছেন, ক’জনই বা সঠিক চিকিত্সা বা অক্সিজেনের অভাবে চলে গেলেন। আর নেই সেই সব মানুষের হাহাকার যাঁদের নিকটজনকে অসহায় ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া দেখতে হয়েছে। আর নেই তাঁদেরও কথা, যাঁরা কোভিডকে হারিয়ে বা এড়িয়েও কাজ হারিয়ে পেটের ভাত জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে বাঁচার রাস্তা খুঁজছেন।

অথচ এই দুরবস্থা অনেকটাই এড়ানো যেত যদি প্রথম ঢেউ প্রশমিত হওয়ার পরেই আমরা দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রস্তুতি নিতাম। ফেব্রুয়ারি মাসেই কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড জয়ের ডঙ্কা বাজিয়ে দিল, যখন গোটা বিশ্বের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে ছিল। বিশেষজ্ঞরাও বারে বারে বলছিলেন দ্বিতীয় ঢেউয়ের অভিঘাত সামলাতে এখুনি প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা তাতে কান দিইনি। কুম্ভ নিয়েও আমরা নিজেদের মুখ লুকিয়েছি বালিতে। এর প্রত্যক্ষ ফল? মধ্যপ্রদেশে কুম্ভ থেকে ফেরা ৬১ জনকে পরীক্ষা করায় দেখা গিয়েছে ৬০ জনই আক্রান্ত।

Advertisement

রাজ্যেও ভোটের মধ্যে যখন প্রচার থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, আমরা তা আমরা গ্রাহ্য করিনি। তার প্রত্যক্ষ ফল রাজ্যে বাড়তে থাকা কোভিড আক্রান্তের আর মৃতের সংখ্যা। কোভিড এ বার বাচ্চাদেরও রেহাই দিচ্ছে না। তাই চিন্তা আরও বেশি।

প্রতীকী ছবি।

অনেকেই বলেছিলেন নির্বাচনের কারণে কোভিড ছড়াবে না। তা হলে দিল্লি বা মহারাষ্ট্রে হচ্ছে কেন? কিন্তু তাঁরা জেনেও যেটা বলেননি না তা হল সংক্রমণ ছড়ায় ঘনিষ্ঠ মেলামেশায়। কোভিড বিধি না মানাই এই কঠিন পরিস্থিতির মূলে। সে মুম্বই হোক বা ভোটের রাজ্যই হোক অথবা কুম্ভ, মূল কারণ তো এটাই।

বিশ্বজুড়ে ভারতের এই মৃত্যুমিছিলের জন্য দায়ী করা হচ্ছে কিন্তু প্রশাসনিক গাফিলতিকেই। আমাদের দেশে অক্সিজেন উত্পাদনের মোট ক্ষমতা এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ছিল ছিল দৈনিক ৭ হাজার ১০০ মেট্রিক টনের একটু বেশি। কিন্তু তখনই অক্সিজেনের চাহিদা দাঁড়িয়েছিল ৬ হাজার ৮২২ মেট্রিক টনের কাছাকাছি। মানে উত্পাদন আর চাহিদা প্রায় সমান।

অনেক জায়গাতেই অক্সিজেনের ঘাটতির জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট আইনের আওতায় তৈরি করা হয় একটি গোষ্ঠী। যাদের হাতে কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভার তুলে দেওয়া হয়। অক্সিজেন বন্টনকেও নিয়ে আসা হয় কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অঙ্গ হিসাবে । তাই রাজ্যগুলোর কিন্তু কার্যত কোনও অধিকারই নেই মানুষের শ্বাসের আশ্বাস দেওয়ার।

আর এই গোষ্ঠী কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর্যালোচনা শুরু করে ১১ এপ্রিল! সরকারি তথ্য বলছে সেই দিনই দেশে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৭০ হাজার। মারা গিয়েছিলেন ৯০৪ জন! এই গোষ্ঠী কাজ শুরু করার ১০ দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় অক্সিজেনের জন্য হাহাকার। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা তখন ব্যস্ত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে। এর মানে তো একটাই। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের অভিঘাত কী হতে পারে তা আমরা বুঝতেই চাইনি, গোটা বিশ্বের উদাহরণ সামনে থাকা সত্ত্বেও।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

মাথায় রাখতে হবে কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে দেশে দরিদ্রের তকমা জুটেছিল নতুন সাড়ে সাত কোটি মানুষের। প্রথম ঢেউয়ের ক্ষত মেলানোর আগেই এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত কিন্তু ভাঙতে পারে অর্থনীতির শিরদাঁড়াটাই। এই ঢেউয়ে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষিত না হলেও কিন্তু লকডাউন তুল্য পদক্ষেপ করতে শুরু করে দিয়েছে বিভিন্ন রাজ্য। আর মার খেয়ে উত্পাদন বন্ধ করার রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র সংস্থাগুলো। একাধিক ক্ষুদ্র সংস্থা যারা প্রথম ঢেউয়ে ঝাঁপ বন্ধ রাখলেও কর্মীদের বেতন দিয়ে চলেছিলেন, এ বার তাঁরা হাত তুলে দিতে শুরু করেছেন। মল বন্ধ। দোকানে খদ্দের কমতে শুরু করেছে। পরিচিত এক ক্ষুদ্র সংস্থার মালিক জানালেন, এ বার তিনি বাধ্য হলেন কারখানার ঝাঁপ বন্ধ করতে। তাঁর তৈরি ছাতা, ব্যাগ ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি হয় বিভিন্ন মলে। রাজ্যে এবং রাজ্যের বাইরে। কিন্তু বড় শহরগুলোতে লকডাউনের মতো পরিস্থিতি। বিক্রি প্রায় নেই। তাই নিরুপায় তিনি বন্ধ করছেন কারখানা।

আর তিনি যে একাই হাত তুলে দিয়েছেন তা তো নয়। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি-র সমীক্ষা বলছে, এই দ্বিতীয় ঢেউ ৭৫ লক্ষ মানুষের কাজ কেড়ে নিয়েছে। প্রথম ঢেউয়ের পরে গত সেপ্টেম্বর মাসে সব থেকে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তার পর ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আবার তা ক্রমাগত পড়তে শুরু করে। খেয়াল করুন, এই ফেব্রুয়ারি মাসেই কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আশঙ্কার কথা বলতে শুরু করেন বিশেষজ্ঞরা আর কেন্দ্রীয় সরকার জোর গলায় দাবি করেন কোভিড যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কথা।

মার্চ মাসে বাজারে বেকারের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৩৮ লক্ষ। তাঁদের মধ্যে ২ কোটি ৮০ লক্ষ চাকরি খুঁজতে সক্রিয় ছিলেন কিন্তু কাজ পাননি। কারণ, উদ্যোগপতিরা জানতেন কী হতে চলেছে। তাই আর নিজেদের দায় বাড়ানোর রাস্তায় হাঁটেননি। আর এখন অভিঘাতের ছোবল তীব্র হতেই একে একে ঝাঁপ বন্ধ করছেন, না হয় ছাঁটাইয়ের রাস্তায় হেঁটে দায় কমাচ্ছেন। অর্থাৎ বাজার আবার গোটাতে শুরু করেছে।

কিন্তু দায় বাড়ছে সরকারের। চারিদিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতির গুরুত্ব মানতে নারাজ ছিলেন তাঁরা। ফেব্রুয়ারি মাসেই যদি কোভিড মোকাবিলার গোষ্ঠী বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা মেনে আপত্কালীন ব্যবস্থার রাস্তায় হাঁটতেন, তাহলে হয়ত সঙ্কট এত তীব্র হত না। এখন তো সাধারণের শ্বাসের টানে জেরবার ধন ও প্রাণ। সিআইআইয়ের মতো বণিক সভাগুলোও বলতে শুরু করেছে এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় লকডাউনের প্রয়োজনীয়তার কথা। প্রশ্ন একটাই, এই ভাবে চলতে থাকলে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি আর্থিক শক্তির একটি বলে গর্ব করা ভারত পারবে তো তার নাগরিকের হারিয়ে যেতে থাকা অস্তিত্ব ফিরিয়ে দিতে?

আরও পড়ুন:

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement