দুই মহাশক্তির সম্মুখসমর। জটায়ু বলিতেন, তাহার ফল হাই ভোল্টেজ ইলেকট্রিক স্পার্ক। দুনিয়াব্যাপী শেয়ার বাজার থরহরিকম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট চিনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য-যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন, প্রত্যুত্তরে চিনও পালটা সিদ্ধান্তের কথা জানাইয়া দিল। ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর আমদানি শুল্ক চাপাইবার পর চিনে প্রস্তুত প্রায় ছয় হাজার কোটি ডলার মূল্যের পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক। এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প বলিয়াছেন, ইহা সূচনামাত্র। এই শুল্ক-যুদ্ধের পরিণতি কী হইবে, বিশ্ববাণিজ্যের উপর তাহার কতখানি প্রভাব পড়িবে, এই প্রশ্নগুলির জুতসই উত্তর এখনই দেওয়া কঠিন। তাহার প্রধানতম কারণ, যুদ্ধটি বাধিয়াছে বিশ্বের দুই বৃহৎ আর্থিক শক্তির মধ্যে। এবং, দেশ দুইটি পরস্পরের সহিত এত বিচিত্র সূত্রে আবদ্ধ যে, একটি সিদ্ধান্তের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া শেষ অবধি কোথায় পৌঁছাইবে, বলা ভার। কিন্তু, একটি কথা স্পষ্ট। মূলত মার্কিন উদ্যোগেই যে মুক্ত ও উদার বাণিজ্য আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইয়াছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাতেই তাহার শোকগাথা রচিত হইতেছে। এবং, তিনি সেই দলের প্রেসিডেন্ট, একদা মিলটন ফ্রিডম্যান যাহার অর্থনৈতিক চিন্তার ধ্রুবতারা ছিলেন। নিয়তির পরিহাস? না কি, রাজনীতির হাতে অর্থনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানের শোচনীয় নিপাত?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাগ্বাহুল্যে যুক্তির সন্ধান কেউ বড়় একটা করেন না। কিন্তু, চিন প্রসঙ্গে তিনি যে কথাগুলি বলিয়াছেন, তাহাতে টাকায় নয়া পয়সার হিসাবে হইলেও যুক্তি আছে। সত্য, চিনের অর্থনীতির বাড়বাড়ন্তের পিছনে মার্কিন প্রযুক্তির বড় ভূমিকা রহিয়াছে। ট্রাম্প অভিযোগ করিয়াছেন, চিনের সরকার চোখ রাঙাইয়া মার্কিন সংস্থাগুলিকে তাহাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ভাগ করিয়া লইতে বাধ্য করে, এবং তাহার ফলে চিন প্রযুক্তিগত গবেষণায় যত ডলার খরচ করে, লাভবান হয় তাহার বহু গুণ বেশি। কিন্তু, এক অর্থে তাহাই কি ভবিতব্য নহে? দুর্জনে বলিয়া থাকে, ট্রাম্প সাহেবের মিটিং-মিছিলে যে ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে সমর্থকরা ভিড় জমান, সেগুলিও ‘মেড ইন চায়না’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব সংস্থাই উৎপাদনের সিংহভাগ চিনে সরাইয়া লইয়া গিয়াছে। কম দামি শ্রম একটি কারণ, ঢিলেঢালা পরিবেশবিধি আরও একটি কারণ। কিন্তু, যুক্তিগুলি সবই অর্থনীতির। রাজনীতির অস্ত্রে তাহাকে খণ্ডন করিতে উদ্যত হইলে সেই সিদ্ধান্ত বিপরীত ফলদায়ী হইবারই সম্ভাবনা। এবং, চিনের অর্থনৈতিক পেশির কথা স্মরণে রাখিলে কাজটি বিপজ্জনকও বটে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ যে দিন রাজনীতির কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হইয়াছে, সেই দিন হইতেই এই বিপদ ঘনাইতেছিল। উদার বাণিজ্যে অর্থনীতির কতখানি লাভ, সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা দুষ্কর। এমনকী, ভারতে যাঁহারা আর্থিক সংস্কারোত্তর প্রজন্মের সন্তান, তাঁহারাও নিজেদের ‘ভাল থাকা’-র কয় আনা কৃতিত্ব উদার বাণিজ্যকে দিবেন, নরেন্দ্র মোদীরা সেই হিসাব জানেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ছবিটি ভিন্ন নহে। ফলে, চিনকে কড়কাইয়া দিলে ট্রাম্প সাহেবের রাজনৈতিক লাভ বিলক্ষণ, অন্তত যতক্ষণ না বাণিজ্যসাগরের উত্তাল ঢেউ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বালির প্রাসাদগুলিকে ভাঙিয়া দেয়। আরও বিপদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় দেশ যদি উদার বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান লয়, তবে ভারতের ন্যায় অপেক্ষাকৃত ছোট দেশগুলিরও সতর্ক হওয়া ভিন্ন উপায় থাকে না। শিল্পমন্ত্রী সুরেশ প্রভু ইতিমধ্যেই সেই সুর গাহিয়া রাখিয়াছেন। ভয়ের কথা, ঘরের রাজনীতিতেও জাতীয়তাবাদের হাওয়া কম তীব্র নহে। মন্দার প্রভাব কাটিতে দশ বৎসরের বেশি সময় লাগিল। বিশ্ব-অর্থনীতি যখন ঘুরিয়া দাঁড়াইতেছে, তখনই এই বাণিজ্য-যুদ্ধ আরও এক দফা দুঃসংবাদ বহিয়া আনিল।