প্রতীকী ছবি।
দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। দুর্গতি নাশ করিবার জন্যই তাঁহার বোধন। রাম রাবণকে বধ করিবার জন্য একশত এক নীলপদ্মে দেবীকে পূজা করিয়াছিলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সে পূজার দীর্ঘ বিবরণ বর্তমান। এককালে বাঙালি কথক তাহা দুলিয়া দুলিয়া পড়িতেন, আসরে উপস্থিত বঙ্গজরা ভক্তিপূর্ণ চিত্তে তাহা শ্রবণ করিতেন। একটি নীলপদ্ম দেবী লুকাইয়া রাখিয়াছেন, রাম তাহা খুঁজিয়া না-পাইয়া পূজা সমাপনের নিমিত্ত আপনার নীলপদ্মবৎ চক্ষু দেবীর চরণে উৎসর্গ করিতে উদ্যত। দেবী রামকে নিরস্ত করিলেন। পূজা সমাপন হইল, রাবণ বধের ক্ষেত্র সু-প্রস্তুত। রাম-রাবণের সে দিন গিয়াছে। তবে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার দিন যায় নাই। বৎসরে একটি বার সপরিবার দুর্গার আরাধনায় বাঙালি রত হয়। সে পূজা এক্ষণে আনন্দোৎসব। পূজাকে ঘিরিয়া অর্থনীতির চাকা ঘুরিতে থাকে। নানা মানুষের নানা উপার্জন, পথে পথে জনসমাগম— বস্তুত, এমন মানুষও আছেন, পূজার সময়েই যাঁহাদের সংবৎসরের রোজগারের সিংহভাগ করিয়া লইতে হয়, বাকি বৎসর আয় নামমাত্র। কলিকাতায় ও কলিকাতার বাহিরে যেখানেই বাঙালির উপস্থিতি, সেখানেই দুর্গার আরাধনা।
তথাপি দিন তো সর্বদা এক রকম যায় না। দেবীর পূজা তো এককালে বসন্তকালে হইত, পরে তা শরৎকালে চলিয়া আসিয়াছে। এ বৎসরেও এই শারদোৎসবের উদ্যোগ আয়োজন ও উৎসবকালীন জনসমাগম লইয়া অনিবার্য শঙ্কা চিন্তাশীল বাঙালিমাত্রেই প্রকাশ করিতেছেন। কারণ, ‘অতিমারি’। জনসমাগম অতিমারিকে এমন পর্যায়ে লইয়া যাইতে পারে যে হয়তো বিপুল লোকক্ষয় হইবে। লোকক্ষয়ের অর্থ তো কাহারও না কাহারও স্বজনবিয়োগ। এই আশঙ্কা যে অমূলক নহে, তাহা ওনাম উৎসবের অভিজ্ঞতাই বুঝাইয়া দিতেছে। আমরা কি তাহা হইলে রামের চক্ষু উৎসর্গ করিবার মতো নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করিতেছি? পুরাকাহিনি অনুসারে দেবী রামকে সে উৎসর্গ হইতে নিরস্ত করিয়াছিলেন। সেই পৌরাণিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইবে না, কিন্তু আমাদের কাণ্ডজ্ঞান ও প্রিয়জনের প্রাণরক্ষার জন্য দায়িত্ববোধ যদি জাগ্রত হয়, তাহা হইলে এই অহেতুক লোকক্ষয় আমরা রোধ করিতে পারি।
পূজা যে কেবল মহাসমারোহে সকলে মিলিয়া করিতে হইবে, তাহা নহে। মানসপূজার বিধান হিন্দুশাস্ত্রেই রহিয়াছে। অতঃপর পূজামণ্ডপে ভিড় না জমাইয়া অনায়াসে গৃহে বসিয়া দেবী দুর্গতিনাশিনী দুর্গার স্মরণ লইতে পারেন। ইহাই গণেশের বুদ্ধি। কৌতুককর পুরাকথা অনুসারে দুর্গা বিশ্বভ্রমণ করিতে বলিলে গণেশ তাঁহাকে প্রদক্ষিণ করেন। কার্তিক ময়ূরবাহন— দেশ-দেশান্তর ঘুরিয়া আসিয়া দেখেন দাদা আগেই বিশ্বভ্রমণ সারিয়া চুপটি করিয়া জননী-সমীপে বসিয়া আছেন। জননীই তাঁহার বিশ্ব। এ কাহিনি আলস্য ও বুদ্ধির মিশেলে রচিত সন্দেহ নাই, জননী ভক্তিযোগে বিশ্ব বলিয়া প্রতিভাত হইলেও যথার্থ ভ্রমণের সহিত তুলনা চলে না । অবশ্য ,কালবিশেষে গণেশ-বুদ্ধিই শ্রেয়। অতঃপর বাড়িতে বসিয়া মনে মনে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া বিধেয়। দরকারে পূজামণ্ডপে মাইক চালাইয়া অঞ্জলির মন্ত্র পাড়ার গৃহে গৃহে স্প্রে করা যাইতে পারে। তাহাতে পূজাও হইবে, প্রাণও বাঁচিবে। খাদ্যাখাদ্য উপভোগেও কতকগুলি বিধি গ্রহণ করা সম্ভব। দল বাঁধিয়া রেস্তরাঁয় না যাইলেই হইল, হোম-ডেলিভারিই সই। না হইলে কাঁচামাল কিনিয়া বাড়িতে স্বহস্তে রন্ধন করুন। গৃহিণীকে দশভুজা না-ভাবিয়া নিজেই নাহয় হাত লাগান। দুইয়ে দুইয়ে চার হইয়া রান্না করিলে বেশ পিকনিক-পিকনিক আমেজ আসিবে। কার্তিক-গণেশ-লক্ষ্মী-সরস্বতীকে কাজে লাগাইয়া দিন। সকলে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। শীতের পিকনিক নাহয় এই বার শরতে নিজগৃহেই হইল।
তবে, এ-সকলই যাঁহাদের আছে তাঁহাদের জন্য। এ দেশে এই অতিমারির সময় কত জনের যে কিছু নাই! এ তো কেবল অতিমারির অকাল নয়, ইহা না-থাকিবার আকাল। দেবী দুর্গা তো অন্নপূর্ণা। যাঁহাদের কিছু নাই, আমরা কি তাঁহাদের সাধ্যমতো কিছু দিবার কথা ভাবিতে পারি না? আমরা অন্নপূর্ণা নহি, তবে অতিমারিতে নীরব-দূরত্ব বজায় রাখিয়া অর্থসঙ্কটগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকিলে দেবীর নাম সার্থক হইবে। সকলেই বিদ্যাসাগরের মতো নিরীশ্বর দাতা নহি ঠিকই, কিন্তু ভক্তির সহিত স্বাস্থ্যবিধির যোগ ঘটাইয়া পূজা পালনে ব্রতী হইলে দেবী খুশি হইবেন। তাহা না হইলে এই পূজা আকাল-বোধনে পর্যবসিত হইতে পারে।
যৎকিঞ্চিৎ
নর্দমার গ্যাস ধরে তা দিয়ে যদি উনুন জ্বালানো যায়, যদি মেঘের আড়াল ব্যবহার করে ফাঁকি দেওয়া যায় রেডারের চোখে, যদি টার্বাইন ঘুরিয়ে হাওয়া থেকে অক্সিজেন ও পানীয় জল নিষ্কাশন সম্ভব হয়, যদি এ প্লাস বি হোলস্কোয়ার মন্থনে উঠে আসে প্লাস টুএবি-র বাড়তি অমৃতভাণ্ড, তবে ঘুঁটের টুকরো অনায়াসে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন ঠেকিয়ে দেবে। ক্রমে মিলবে গরুর নিঃশ্বাসে অক্সিজেন, গরুর দুধে খাঁটি সোনা। গোমূত্রে যদি মিলে যায় কোভিডের টিকাও?