উদ্যোগ: বোলপুরে বুধবার মাদক-বিরোধী মিছিল। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
একবিংশ শতাব্দীতে একদিকে যেমন আমরা বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে উন্নয়ন যজ্ঞে গা ভাসিয়েছি —আমাদের জীবন হয়েছে সুখকর ও আনন্দদায়ক , ঠিক তেমনই এই আধুনিক সভ্যতার কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমাজে তৈরি করেছে এক অমোঘ শূন্যতার আবহ , যা মানুষের মন থেকে মনন —সব ক্ষেত্রেই ক্রিয়াশীল। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে ঘরে ঘরে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির সংস্কৃতি একসঙ্গে সুখ দুঃখ ভাগ করে মিলেমিশে থাকার পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ফারাক, জীবনের প্রতিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, আর এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য শুধুই ছুটে চলা, সামাজিক অবক্ষয়ের গ্রাসে মানবিক মূল্যবোধের মূল্যহীনতা, রুচিশীল সুস্থ স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের অভাব, লক্ষ্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা,কর্মসংস্থানের অভাব—এই সব মিলিয়েই আজ আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে গিয়েছে কয়েকটি শব্দ — নিঃসঙ্গতা, হতাশা, একাকিত্ব। ঠিক এই সুযোগেই গোপন দুষ্টচক্র সক্রিয় হয়ে যুবসমাজের হাতে তুলে দিচ্ছে ড্রাগ। এই মাদকের নেশা শুধু ব্যক্তির সম্ভাবনাময় জীবনকেই ধ্বংস করে না, তা পরিবার, সমাজ তথা সমগ্রজাতিকেই গ্রাস করে নিতে চায়। এ এক গভীর চক্রান্ত। আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রও এর সাথে জড়িত। তরুণরাই যেহেতু দেশের ভবিষ্যৎ , তাই ষড়যন্ত্রকারীদের প্রথম লক্ষ্য যুবশক্তি। তাদেরকে মাদকের জালে জড়িয়ে পঙ্গু ও অসাড় করে সমাজের মেরুদণ্ডকেই ভেঙে দিতে চাইছে স্বার্থান্বেষী চক্রান্তকারীরা। এই মাদকের নেশা সমাজের পক্ষে এক অভিশাপ। সাময়িক আনন্দ লাভের আশায় মানুষ নেশায় আসক্ত হয়। কিন্তু সেই সর্বনেশে নেশাই ধীরে ধীরে তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। সর্বশেষ পরিণতি অকাল মৃত্যু! নেশার দুনিয়ায় প্রবেশ করা সহজ কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসা দুঃসাধ্য।
নেশা বা মাদকাসক্তি হল এমন এক মানসিক বা শারীরিক অবস্থা যা মাদকের সঙ্গে জীবিত প্রাণীর মিথস্ক্রিয়ায় তৈরি হয় এবং তা ওই নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির শারীরিক ক্ষতি যেমন করে, ঠিক তেমনি তাকে মানসিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে চালিত করে সমাজে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালে আমরা দেখতে পাই মাদকাসক্তির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রথম দিকে মদ, ভাং, চরস, বিড়ি, সিগারেট, খৈনি, গুটকা,আফিম(পপি গাছের রস থেকে তৈরি এক প্রকার মাদক), গাঁজা ইত্যাদির ব্যবহার হতো মাদক হিসেবে। পরবর্তী সময়ে সেই জায়গা দখল করে নেয় ‘ড্রাগ’। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়ে বিজ্ঞানীরা মানুষের কল্যাণে আবিষ্কার করলেন বিভিন্ন ধরনের জীবনদায়ী বেদনানাশক ওষুধ বা ‘ড্রাগ’ যা ধীরে ধীরে নেশার সামগ্রী হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। কোকেন, হেরোইন, এন ১০, ব্রাউন সুগার, কোরেক্স, মারিজুয়ানা, বারবিচুয়েট, ম্যানডেক্স, এল.এস.ডি., ইয়াবা—এই সমস্ত মাদক হিসেবে বহুল প্রচলিত। এই সমস্ত ড্রাগ আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে সহজলোভ্য হয়ে উঠেছে। একটা সময় ভিয়েতনাম,থাইল্যাণ্ড ও মায়ানমার মাদক চোরাচালানের স্বর্গভূমি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। এখন আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরান সেই জায়গা দখল করেছে। এছাড়া কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, সুদান, নাইজেরিয়া, রাশিয়া, আমেরিকাতেও এর বিরাট নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রসঙ্গত, ফরাসি বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পরাজিত ও আহত সৈন্যরা হতাশা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ব্যাপকভাবে মাদকে আসক্ত হন। পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলিতেই প্রথমে বেদনানাশক ‘ড্রাগ’গুলি নেশার সামগ্রীতে পরিণত হয়। তারপর ধীরে ধীরে তা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে।
সাময়িক আনন্দ লাভের আশায় নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা মাদকাসক্ত হয়ে ওঠে আর ধীরে ধীরে তাদের নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ড্রাগের নেশার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ক্ষতিকর দিকের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই সমস্ত মাদক যদি শরীরে একবার প্রবেশ করে তাহলে তা বার বার গ্রহণের তীব্র ইচ্ছা মানুষকে দিশেহারা করে দেয়। সেখান থেকে জন্ম নেয় অপরাধ প্রবণতা। নিয়মিত মাদক সেবনের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা জোগাড়ের জন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তি চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই করতেও দ্বিধাবোধ করে না। সর্বনেশে ড্রাগের নেশা ব্যক্তির পুরো স্নায়ুতন্ত্রকেই বিকল করে দেয়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে। শারীরিক ও আচরণগত ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। খিদে কমে যায়, ফলে দ্রুত ওজন কমতে থাকে। ঘুমের স্বাভাবিক সময়সীমা পরিবর্তিত হয়ে যায়। নাক দিয়ে রক্ত পড়ে, চোখের মনির স্বাভাবিক আকারে পরিবর্তন আসে আর চোখ সবসময় লাল হয়ে থাকে। মাদকাসক্ত ছাত্রছাত্রীরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যেতে চায় না; নেশায় আসক্ত চাকুরীজীবীরাও কর্মক্ষেত্রে অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তারা পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে নিত্য নতুন নেশার ঠেকে নতুন নতুন বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস সংক্রান্ত নানা জটিল রোগ এদের নিত্যসঙ্গী। ড্রাগ গ্রহণকারী একাধিক ব্যক্তি নেশা করার সময় অনেকক্ষেত্রে একই সিরিঞ্জ ব্যবহার করে, ফলে তারা মারণ রোগ এইডসের হাত থেকেও রেহাই পায় না। এ ভাবেই মাদকাসক্ত ব্যক্তি শরীর মন সব দিক থেকেই হতাশার গভীর অন্ধকারে ডুবে শেষ পর্যন্ত অকালে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আসলে মাদক একটি সামাজিক ব্যাধি। এর ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া দেখে অভিভাবকেরা যেমন দিশেহারা, ঠিক তেমনি চিকিৎসকরাও বিচলিত, আর সেই সঙ্গে প্রশাসনও আতঙ্কিত। নানা কারণে নবীন প্রজন্ম অর্থাৎ যুবসমাজের কাছেই ড্রাগের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। অথচ যুবক - যুবতীরাই যেকোনো দেশের ভবিষ্যৎ , তারাই চালিকাশক্তি।
তবে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। এক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার হল জনসচেতনতা। সমাজের প্রতিটি মানুষকে বোঝাতে হবে যে, মাদক আসলে মৃত্যুর সমার্থক। একজন বাচ্চা যখন বড়ো হয় তখন তার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব থাকে পরিবারের, কারণ সে পরিবারেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটায়। বাবা - মাকে সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। পরিবারের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক আনন্দদায়ক পরিবেশ বজায় রাখাও একান্ত ভাবে জরুরি। সন্তানের সারাদিনের কার্যকলাপ ও সঙ্গীদের ব্যাপারে ভালোভাবে খবরাখবর রাখতে হবে। ধৈর্য ধরে তাদের কথা শুনতে হবে, তাদের মনের মধ্যে যে দ্বিধা - দ্বন্দ্ব - সংশয় - কৌতূহলের জন্ম হয় তা খোলা মনে আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করতে হবে। যেন পরিবারের মধ্যে বিশ্বাসের একটা বাতাবরণ তৈরি হয়। নিজের সুখ - দুঃখ , ভালোলাগা - মন্দলাগার অনুভূতি যেন একজন সবার সাথে ভাগ করে নিতে পারে। তাহলেই কাজ অনেকটা সহজ হবে। সেই সঙ্গে গতানুগতিক একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সাংস্কৃতিক বিনোদনমূলক পরিবেশও জরুরি। আর যদি পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তাকে সেই অবস্থা থেকে বের করে আনতে সকল সদস্যের সর্বাত্মক প্রয়াস প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ভালোবাসা, সহানুভূতি যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি দীর্ঘমেয়াদি সঠিক চিকিৎসাও প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষক সমাজের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়—প্রত্যেক স্তরেই সঠিক পরামর্শ ও নির্দেশনার প্রয়োজন। একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা তাঁর জ্ঞান-বোধ-বিদ্যা-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা ও স্নেহময় ভালোবাসার মাধ্যমে কোনো শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে জীবনযাপনের দিশা দেখাতে পারেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মাদকাসক্তির কুফল বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনাচক্র, বিতর্কসভা, পথনাটিকা—এইসব জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতে হবে। আর এই বিশাল কর্মযজ্ঞে প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের নেটওয়ার্ককে পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তথ্য আদান প্রদানে আরও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তদেশীয় গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং তার আধুনিকীকরণ করতে হবে। যেভাবেই হোক সর্বনেশে ড্রাগের সহজলভ্যতা বন্ধ করতে হবে।
জনসচেতনতা প্রসারে সর্বাত্মক সরকারি পদক্ষেপ জরুরি। সেই সঙ্গে সবধরনের গণমাধ্যমকেও সদর্থক ভূমিকা পালন করতে হবে। ড্রাগ-ড্রাগনের কালো থাবা থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ইন্টারনেটের গঠনমূলক ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। গণমাধ্যম সুস্থ সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে মাদক বিরোধী বার্তা খুব সহজেই পৌঁছে দিতে পারে।
লেখক লাঙ্গুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক (মতামত ব্যক্তিগত)