গাড়ি ব্যবসায় মন্দা। প্রতীকী ছবি।
জুলাই মাসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গাড়ির মোট বিক্রির ৮৫% যে পাঁচটি সংস্থা থেকে আসে, তাদের বিক্রির হার কমেছে ৩৩%। মারুতি এবং হন্ডার বিক্রি কমেছে সবচেয়ে বেশি— ৩৬.৭১% আর ৪৮.৬৭%। বিশেষত মারুতির বিক্রি এই ভাবে কমে যাওয়ার অর্থ ক্রেতাদের হাতে যথেষ্ট পয়সা নেই। যাঁদের আছে, তাঁরাও এই মুহূর্তে না কেনার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। গোটা অর্থব্যবস্থায় মন্দার উপস্থিতির এটা একটা বড় সূচক।
ব্যক্তিগত গাড়ি, ব্যবসায়িক কাজের গাড়ি, দু’চাকা ও তিন-চাকা সমস্ত ধরনের গাড়ি বিক্রির বৃদ্ধির হার নতুন আর্থিক বছরে ৫% থেকে ১০%-এরও বেশি কমেছে। যাত্রিবাহী ব্যক্তিগত গাড়ি আর দু’চাকা ও তিন-চাকার গাড়ি বিক্রিই এই শিল্পের মেরুদণ্ড। এই গাড়ি বিক্রি হলেই শিল্পও চলে গড়গড়িয়ে। লক্ষণীয়, ২০১৮-১৯ সালে এই সেগমেন্টে রফতানি বৃদ্ধির হারও কমেছে।
উৎপাদক সংস্থাগুলি গোড়ায় সম্ভবত ভেবেছিল, এই মন্দা সাময়িক— উৎসবের মরসুম এলে এবং রফতানির হার স্বাভাবিক হয়ে গেলে অটোমোবাইল শিল্পে চাহিদা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পরিসংখ্যান দেখলে অন্তত তাই মনে হয়। বিক্রির বৃদ্ধির হার গত এক বছর ধরে পড়তে থাকলেও সেই অনুযায়ী উৎপাদন কমেনি। তাতে হয়েছে বিপদ— সব সংস্থার গুদামেই বিক্রি না হওয়া গাড়ি পড়ে আছে। এই অবস্থায় এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিক ও অন্য কর্মীদের চাকরি যাবে, স্বাভাবিক ভাবেই।
প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান তো বটেই, অনুসারী শিল্পেও কর্মসংস্থান বিপন্ন। গোটা দেশে এমন অনেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস্টার আছে, যেখানে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি হয় নির্দিষ্ট কোনও সংস্থার নির্দিষ্ট কারখানার জন্য। যেমন, ঝাড়খণ্ডের আদিত্যপুরে যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানাগুলোর উৎপাদন জামশেদপুরের গুটিকতক ব্যবসায়িক গাড়ি তৈরির কারখানার ওপর নির্ভরশীল। এই রকম কারখানায় কর্মীদের জীবিকা যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সম্প্রতি জানা গেল, আদিত্যপুরে ৩০,০০০ কর্মী চাকরি খুইয়েছেন।
গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির এক শিল্প সংগঠনের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, মন্দা অব্যাহত থাকলে কিছু দিনের মধ্যেই ১০ লাখ কর্মী চাকরি হারাতে পারেন। অটোমোবাইল ডিলারদের সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, বিগত তিন মাসে দেশের নানা প্রান্তের গাড়ির ডিলারশিপে কর্মরত দু’লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ডিলারদের সমস্যা তীব্রতর হয়েছে কারণ তাঁদের অনেকেই ব্যাঙ্ক নয়, এমন আর্থিক সংস্থা (এনবিএফসি) থেকে নেওয়া ঋণের ভিত্তিতে ব্যবসা চালাতেন। এই আর্থিক সংস্থাগুলিতে সাম্প্রতিক গোলযোগের ফলে এই সূত্র থেকে আসা ঋণের পরিমাণও অনেকখানি কমেছে।
এই মন্দার অন্য কারণও আছে। ২০১৬ সালে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত করে, ২০২০ সালের পয়লা এপ্রিলের মধ্যে ভারত স্টেজ (বিএস) চার থেকে সরাসরি বিএস ছয়-এ চলে যাওয়া হবে। উল্লেখ্য, এই স্টেজগুলি দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের। সুপ্রিম কোর্টও এই সিদ্ধান্তটিকেই বহাল রাখে। ইউরো সিক্স-এর সঙ্গে তুলনীয় বিএস ছয়-এ যেতে হলে গাড়িতে প্রযুক্তিগত বেশ কিছু উন্নতি প্রয়োজন, যার জন্য বড় রকম লগ্নি জরুরি। অর্থাৎ, নির্মাতা সংস্থাগুলিকে নতুন পুঁজি ঢালতে হবে। অন্য দিকে, ক্রেতারাও দেখে নিতে চাইবেন, গাড়িগুলো কেমন দাঁড়ায়— কিনলে কী ধরনের গাড়ি কিনবেন তাঁরা। কাজেই, গাড়ির বাজারে ২০১৬ সাল থেকেই একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
শিল্পের এই রকম টালমাটাল অবস্থায় এ বারের বাজেট আর একটি অনিশ্চয়তার বীজ পুঁতেছে— বৈদ্যুতিক গাড়ি। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার চায় ভারত বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হোক। এই লক্ষ্যে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে বাজেটে— জিএসটির হার কমিয়ে দেওয়া, বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্রেতাদের নেওয়া ঋণে কর-ছাড় ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। অটোমোবাইল শিল্প কি এই ধরনের গাড়ি উৎপাদনের জন্য তৈরি? না কি, আরও বড় ধাক্কা আসছে?
প্রথম সমস্যা, বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে কোনও পরিষ্কার সরকারি দলিল নেই, সময়সীমাও ধার্য করা নেই। ২০১৭ সালে কেন্দ্র জানিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতীয় গাড়ি-শিল্প ১০০% বৈদ্যুতিক হবে। ২০১৮-তে সেই লক্ষ্যমাত্রা কমে হল ৩০%। ইতিমধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ির পক্ষে জোরালো সওয়াল করতে থাকা নীতি আয়োগ প্রস্তাব দেয়, ওলা বা উবরের মতো সংস্থাকে ২০২৬ সালের মধ্যে ৪০% বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত সমস্ত নতুন গাড়িও বৈদ্যুতিক করার প্রস্তাব দেয় নীতি আয়োগ। কিন্তু সরকার স্পিকটি নট। শিল্পে এই অনিশ্চয়তা প্রাণঘাতী।
এই মুহূর্তে বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং গাড়ির যন্ত্রাংশ ও ব্যাটারি তৈরির পরিকাঠামো ভারতে নেই। এর বেশ কিছু প্রভাব পড়বে ভবিষ্যতে। প্রথমত, বৈদ্যুতিক গাড়িকে আরও সক্ষম, আরও সহজলভ্য করে তোলার জন্য যে গবেষণা প্রয়োজন, তাতে উৎপাদনের খরচ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, ব্যাটারি চার্জ বা বদলে নেওয়ার পরিকাঠামো ঠিক ভাবে তৈরি না হলে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের ওপরে তার কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। তৃতীয়ত, ব্যাটারি প্রযুক্তি ও রসায়ন নিয়ে ভারতে গবেষণার অভাব বৈদ্যুতিক গাড়ির উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করবে। চতুর্থ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই সব কিছুতে যা খরচ হবে তার পরে বৈদ্যুতিক গাড়ির এবং তার ব্যাটারির যা দাম দাঁড়াবে, তা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা— অথচ মধ্যবিত্ত ক্রেতারাই ভারতীয় অটো শিল্পের ইঞ্জিন।
কেন্দ্র যদি ভারতে বৈদ্যুতিক গাড়ি চালু করতে অধীর হয়, তাতে সবচেয়ে লাভ চিনের বৈদ্যুতিক গাড়ি ও যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারীদের। তাঁদের কাছে প্রযুক্তি, অর্থ, সামর্থ্য— সবই আছে। ফলে, চিনা গাড়িতে ভারতের রাস্তা ভরে যাওয়ার সম্ভাবনাও বিপুল। বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির প্রাণকেন্দ্র হওয়ার বাসনা কি শেষে চিন থেকে গাড়ি আর গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করে মেটাতে হবে?
নয়াদিল্লিতে অবজ়ার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে সিনিয়র ফেলো