ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদী।
ভারতের মাটিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পা রাখিবার আগে পর্যন্ত জানা ছিল, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সহিত বৈঠকে কিছু সংবেদনশীল বিষয় তুলিবেন, যেমন সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। ইহা ভারতের লিবারাল কিংবা বাম সংবাদমাধ্যমের দিবাস্বপ্ন ছিল না, হোয়াইট হাউস-এর আধিকারিকরাই এমন বার্তা দিয়াছিলেন। এমনও বলিয়াছিলেন যে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি কথাবার্তার সূত্রে উঠিবেই, কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট তাহা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ট্রাম্পের সফর শেষ হইল। ভারতে থাকাকালীন তিনি খাস রাজধানী শহরকে ধর্মের ভিত্তিতে উত্তাল ও হিংস্র হইয়া উঠিতে দেখিলেন। সেই হিংসার প্রত্যক্ষ কারণ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বলিয়া আক্রমণকারীরা নিজেরাই ঘোষণা করিয়াছে, শুনিয়া গেলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত যাহা বলিতে শোনা গেল, তাহা প্রধানমন্ত্রী মোদীর নিখাদ ও উচ্চগ্রামের প্রশংসা, যাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য— মোদী বিষয়ক দুইটি তারিফ: এক, মোদী ‘শান্ত ও ধার্মিক’, দুই, মোদী দেশে নাগরিকের সমানাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করিয়াছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম কোন ছার, মার্কিন সংবাদমাধ্যমও সফররত প্রেসিডেন্টের এ-হেন ভোল পরিবর্তনে সম্ভবত বিস্মিত। স্বভাবত বিতর্কিত ট্রাম্প সম্পূর্ণ স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে মোদীর প্রভূত গুণগান করিয়াছেন, ভারতের গণতন্ত্রের গালভরা প্রশংসা করিয়াছেন। আপাত ভাবে গণতন্ত্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধ মার্কিন রাজনৈতিক সমাজের চোখে ট্রাম্পের এই ভোলবদল কী ভাবে গৃহীত হইবে, তাঁহারা ইহাতে বিরক্ত হইবেন না প্রসন্ন হইবেন, তাহা দেখিবার।
বাস্তবিক, অতি আগ্রহসহকারে দেখিবার। কেননা, ট্রাম্প যাহা করিয়া এবং বলিয়া গেলেন তাহাতে নরেন্দ্র মোদী, ভারতীয় জনতা পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আন্তরিক খুশি হইবার অনেক কারণ। আমদাবাদের বর্ণাঢ্য শোভা, ট্রাম্প-মোদীর যৌথ সাবরমতী আশ্রম পরিভ্রমণ, পরস্পরের উপর মুগ্ধ প্রশংসাবাক্য বর্ষণ, অগণিত আলিঙ্গন-মুহূর্ত, সব মিলিয়া ইহা বর্তমান ভারতীয় সরকারের একটি বিরাট বিজয়মুহূর্ত। ভারতকে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন স্ট্র্যাটেজিক গ্লোবাল পার্টনার হিসাবে গণ্য করিতেছে, ইহাও কূটনৈতিক লাভ। অন্তত এই বারের সফরে ভারত যে পাকিস্তানের সহিত এক ব্র্যাকেট হইতে বাহির হইয়া আসিতে পারিল, এয়ার ফোর্স ওয়ান যে ইসলামাবাদ না ছুঁইয়া সরাসরি ওয়াশিংটন ডিসি হইতে দিল্লি, এবং দিল্লি হইতে ডিসি যাতায়াত করিল, ইহাও কম কথা নহে। ভারতের পক্ষ হইতে মার্কিন অস্ত্র কিনিবার ব্যবস্থা ও দুই দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহযোগিতাও নিশ্চয়ই প্রাপ্তিযোগ, যদিও নূতন প্রাপ্তি বলা যায় না। এই দুইটি ক্ষেত্রে ভারত-মার্কিন সহযোগিতা পূর্বাবধি শক্তপোক্ত। প্রতিশ্রুতিগুলিও পুরাতন। কথা হইল, এই সবই দিল্লির জন্য কম-বেশি সুসংবাদ, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই অতি-আগ্রহী মোদী-ভজনা হইতে রাষ্ট্রগত ভাবে কী অর্জন করিলেন, তাহা এখনও অস্পষ্ট।
নয়াদিল্লিকেও ভাবিতে হইবে, বিবিধ প্রশংসা-বার্তা ভিন্ন যতখানি প্রাপ্তির স্বপ্ন তাহারা দেখাইয়াছিল, তাহা পূর্ণ হইল কি না। কূটনৈতিক দিক দিয়া, অস্ত্র-ক্রয়ের বোঝাপড়া ভিন্ন একটিও নূতন চুক্তি হইল না। অন্য দিকে, বাণিজ্য চুক্তির খড়্গটি ভারতের মাথার উপর হইতে অপসারণে ট্রাম্প যে নারাজ, সেই সত্য তিনি জানাইয়া গেলেন— তাঁহার ‘খুব ভাল চুক্তি হইবে’ মন্তব্যটির সরল অর্থ: মার্কিন পণ্য ও পরিষেবার জন্য ভারতকে তাহার বাজার খুলিতেই হইবে, শুল্ক কমাইতেই হইবে। অতএব, শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তই জাগিয়া থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুই জনেই এই মিত্রতার প্রদর্শনী হইতে ব্যক্তিগত স্বীকৃতি ও রাজনৈতিক নম্বরই চাহিয়াছিলেন, তাহার অধিক কিছু নহে।