অত্যাচারী শাসকেরা সদুপদেশ-বর্জিত, কারণ তাদের জীবন কাটে স্তাবক পরিবৃত হয়ে, বলেছিলেন প্লেটো। অ্যারিস্টটল সতর্ক করেছিলেন, বাক্যবাগীশ ‘ডেমাগগ’ নেতার উদয় গণতন্ত্রের সমস্যা, তাঁরা মানুষের জেদ ও দুর্বলতা খুঁচিয়ে তোলেন। বিপদ বুঝেই আমেরিকার সংবিধান রচয়িতারা পত্তন করেন ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’ ব্যবস্থা, যাতে কোনও একক প্রতিষ্ঠান মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা অর্জন করতে না পারে, করলেও অন্য প্রতিষ্ঠান যেন ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর চার বছরে এই ভারসাম্য ফেরানোর যন্ত্র অনেকটা অকেজো করে ফেলেছিলেন। নইলে তাঁর গণতন্ত্র বিরোধী হাবভাবে রিপাবলিকান পার্টিই অনেক আগে তাঁকে হোয়াইট হাউস থেকে বিতাড়নের পদক্ষেপ করতে পারত। আমেরিকান সংবিধানে ইমপিচমেন্ট ছাড়াও এমন ব্যবস্থা আছে যাতে প্রেসিডেন্ট বেয়াড়াপনা করলে আইন প্রণেতাদের সমর্থন নিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট তাঁকে বরখাস্ত করতে পারেন। কিন্তু ট্রাম্প তাঁর গুন্ডা-অনুচরদের লেলিয়ে ক্যাপিটলে হামলা করালেও প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স রা কাড়েননি।
গণতন্ত্র বিগড়ানোর কলটি ট্রাম্প-যুগে সোশ্যাল মিডিয়া। ২০১৬-য় তাঁর নির্বাচনের সময় থেকেই ট্রাম্প তা ব্যবহার করে আসছেন, শুধু গালি নয়, উন্মত্ত সমর্থকদের প্ররোচনা দিতেও।
ক্যাপিটলে হামলা ট্রাম্প কর্তৃক তাঁর ভক্তদের টুইটারে ‘আমন্ত্রণ’-এর ফলে, এবং ‘পারলার’ নামক অন্য একটি আলাপ-মাধ্যমে প্রচারিত ‘উপদেশ’-এর ধাক্কায় (যেমন, ‘সঙ্গে একটা অ্যাসল্ট রাইফেল যেন থাকে’)। স্বৈরতান্ত্রিক নেতাদের এই অসত্যের ফুলঝুরি সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘পোস্ট ট্রুথ’। কিন্তু পোস্ট ট্রুথের কামান দেগেও ট্রাম্প হারলেন। এ বার তাঁর বক্তব্য, জো বাইডেন ভোটে জেতেননি, নির্বাচনটাই চুরি করা হয়েছে। হৃত নির্বাচন ফিরিয়ে আনার হুকুম তামিল করতেই ভক্তকুল যুদ্ধে নেমেছিল।
টুইটার ও ফেসবুক এত দিন ট্রাম্পের আজগুবি পোস্টের নীচে ‘এই বক্তব্য তথ্যনির্ভর নয়’ লিখে দায় সারত। ভোটে হারা প্রেসিডেন্ট সরাসরি হিংসা ছড়ানোয় তাদের আর উপায় রইল না। টুইটার ট্রাম্পের প্রবেশ নিষিদ্ধ করল প্রথমে কয়েক ঘণ্টার জন্য, পরে চিরতরে। ফেসবুক, ইউটিউবও।
এই গন্ডগোলের মধ্যেই সামনে এল আর এক রহস্য, চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সিলিকন ভ্যালির যোগ। ট্রাম্প আমলের গোড়ায় শুরু হয় ‘গ্যাব’ নামক মঞ্চ। ২০১৮-য় ‘পে প্যাল’ প্রভৃতি উচ্চসারির বিজ্ঞাপনদাতারা ‘গ্যাব’ থেকে সরে যায়, কারণ সেখানে জাতিবিদ্বেষী পোস্ট ঠাঁই পাচ্ছিল। এক ইহুদি-বিরোধী পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় পিটসবার্গের এক বাসিন্দা স্থানীয় ইহুদি প্রার্থনাগৃহে গুলি চালিয়ে এগারো জনকে হত্যা করে। পুলিশের চাপে কিছু দিন গ্যাব নিষ্ক্রিয় হয়, সেই মওকায় ‘পারলার’-এর শুরু। জন ম্যাটজ়া নিজেকে বলেন ‘মুক্ত কণ্ঠের উপাসক’, কিন্তু তাঁর ব্যবসায় প্রচুর অর্থ ঢেলেছেন ট্রাম্পের অনেক ধনকুবের সমর্থক, বিশেষত উগ্র দক্ষিণপন্থী ‘ব্রেইটবার্ট নিউজ়’-এর আংশিক মালিক রেবেকা মার্সার। কোথায় কী ভাবে হিংসা ছড়াতে হবে, কেমন করে দমাতে হবে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন, সে নির্দেশ ভক্তদের কাছে একান্তে প্রচারের মঞ্চ পারলার। ৬ জানুয়ারির পর অ্যাপল স্টোর ও গুগল প্লে পারলারকে উৎখাত করে। অ্যামাজ়নও মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
তবে সমাজের একটি অঙ্গ যতই অশুভ হোক, তার কণ্ঠরোধ করে তাকে চুপ করানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে উদারবাদীরাও চিন্তিত। টুইটারের মতো বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কি কোনও রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রচারযোগ্যতা বিচারের এক্তিয়ার আছে? ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রের অধ্যাপক ইউজিন ভোলখ লিখেছেন, তাঁর মতে ফেসবুক বা টুইটার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বলে তারা ‘প্রথম সংশোধন’-এর (আমেরিকান সংবিধানে ‘ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট’ হল মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সরকারি হস্তক্ষেপের ক্ষমতায় অঙ্কুশ) আওতাভুক্ত নয়। কিন্তু বেসরকারি সংস্থার কাছে এই ক্ষমতা অপব্যবহারের অনেক সুযোগ। ভোলখ চিন্তিত, অযোগ্য সরকারের বিরুদ্ধে পরে জনরোষ ফুঁসে উঠলে সিলিকন ভ্যালির প্রভুরা আগে দেখবেন ক্ষমতাসীন সরকার তাঁদের বাণিজ্যিক স্বার্থের রক্ষক না পরিপন্থী। তাঁদের পক্ষে সুবিধাজনক হলে তাঁরা বিরোধী মত প্রকাশ করতে দেবেন কেন?
ভারতেও এ বিতর্ক চলবে, কারণ স্মার্টফোনের বিশ্ববিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ— কলকাতার ব্রিগেড গ্রাউন্ড বা দিল্লির বোট ক্লাব— এখন মোবাইলের পর্দায়। সাম্প্রতিক কালে দিল্লির দাঙ্গার মুখ্য ইন্ধনদাতা বিজেপি নেতাদের মূল অস্ত্র ছিল চটজলদি জড়ো করা ১২৫ জনের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, নাম ‘কট্টর হিন্দু একতা’।
‘স্মার্টফোন গণতন্ত্র’-এর এই যুগে দেশে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক নেতারা পোস্ট ট্রুথের ছড়ি ঘুরিয়ে জনতার এক বিপুল অংশকে চালনা করেন। তাকে সংযত করার কোনও পথ এখনও বেরোয়নি। ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পরেও নয়।