Education

লেখাপড়া শিখে কী লাভ হল?

ভরা অফিসে চা নিয়ে আসেন অম্বরীশ। চল্লিশ পেরিয়েছে বলে সরকারি চাকরির দরজা বন্ধ।

Advertisement

সন্দীপন নন্দী

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২০ ০০:০৫
Share:

ফাইল চিত্র

আমায় একটা লেখার কাজ দেবেন দাদা? বহু দিন লিখিনি। স্টিয়ারিং ধরে ধরে হাতে কড়া পড়ে গেল।’’ এক সরকারি আধিকারিকের গাড়ি চালাতে চালাতে ভরদুপুরে কথাগুলো শুনিয়েছিলেন বাংলা অনার্স ধনঞ্জয়। দু’বার স্কুল সার্ভিস কমিশনের ভাইভা-ফেরত। জাগরী, ঢোঁড়াই চরিতমানস, দিবারাত্রির কাব্য গুলে খাওয়া ছেলে, মাসে পাঁচ হাজার টাকায় গাড়ি চালান।

Advertisement

ভরা অফিসে চা নিয়ে আসেন অম্বরীশ। চল্লিশ পেরিয়েছে বলে সরকারি চাকরির দরজা বন্ধ। গানের টিউশনে সংসার টেনেটুনে চলে। রবীন্দ্রভারতীর ‘এম মিউজ’ অম্বরীশ সরকারি দফতরে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। চা বানান, ফাইল ঝাড়েন, অফিসের গেটে তালা দেন। মাসে বেতন চার হাজার টাকা।

দুপুর দুটো। টিফিন আওয়ার। অনুভাদি খাবার চাইতে এলেন। দুপুরটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। আশির দশকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতক। এখন বই পড়লে মাথা ঘোরে। লুকিয়ে এক বার নাকি ‘নেট’ পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। অধ্যাপিকা হওয়া হয়নি, তবে ঝড়ের বেগে টাইপ করতেন। সরকারি দফতরে চুক্তিভিত্তিক মহিলা পিয়নের কাজ করতে করতে এখন টাইপ ভুলে গিয়েছেন। সামান্য রোজগার, কিন্তু ভাইয়েরা দিদির হাতে এটিএম কার্ড দেয় না। এক বার নাকি বিষ কিনেছিলেন।

Advertisement

ভাল খবরও অবশ্য মেলে। খাবারের ডেলিভারি বয় এক দিন বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা পাশ করে প্রণাম করতে এসেছিল।

হয়তো বলবেন, এমন তো হয়েই থাকে। চাকরি কি চাইলেই পাওয়া যায়? সামান্য একটা কাজের জন্য কত আবেদন জমা পড়ে। ঠিকই। কিন্তু মেধার, প্রতিভার, আত্মবিশ্বাসের অন্তর্জলি যাত্রা যে চলছেই, তা দেখেও একটা গোটা সমাজ নীরব বসে থাকবে? কোনও কথাই বলবে না? কেন আমাদের মাথা হেঁট হয় না, যখন পিএইচ ডি ছাত্র ডোমের পদে আবেদন করে? বরং একটা মেধাবী ছেলের হার মেনে-নেওয়া, দুমড়ে-যাওয়া মুখকে দেখে বিদ্রুপ করতে আমাদের বাধে না। রাষ্ট্র বলছে, যোগ্যতার প্রমাণ দাও। না হলে চাকরির বাজারে যা পেয়েছ নিয়ে নাও। সমাজ বলছে, একটা ভাল কাজ জোটাতে পারোনি, লজ্জা করে না?

ধনঞ্জয়, অনুভাদিদের লজ্জা দেওয়া, তাচ্ছিল্য করা খুব সোজা। কিন্তু রাষ্ট্র যে উচ্চশিক্ষাকে সম্মান করতে পারছে না? যিনি সমাজকে দু’হাত ভরে দিতে পারতেন, তাঁকে এক ফোঁটার বেশি দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না— এ কি দেশের ক্ষতি নয়? মানবসম্পদের অপচয় নয়? এমন তো নয় যে আমাদের দেশে প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি লোক স্নাতক, স্নাতকোত্তর পড়ে ফেলেছে। ভারতে স্কুল ছাড়ার পর মাত্র ছাব্বিশ শতাংশ ছেলেমেয়ে কলেজে ভর্তি হচ্ছে, যেখানে চিনে ভর্তি হচ্ছে আটচল্লিশ শতাংশ, জাপানে তেষট্টি শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় তিরানব্বই শতাংশ। ভারতকে উন্নত দেশ হতে হলে আরও অনেক তরুণ-তরুণীকে আনতে হবে উচ্চশিক্ষায়। অথচ আমাদের ভাবটা এমন, যেন উচ্চশিক্ষা যেন মুড়কি-মুড়ির খোলা বাজার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে কাজের জগতেও সম্মান নেই, সমাজেও না।

ভারতের অর্থনীতি কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জন্য যথেষ্ট কাজ তৈরি হয়নি। এর জন্য সরকারি নীতি কতটা দায়ী, চেষ্টা করলে সরকার শিল্পপতিদের কতটা প্রভাবিত করতে পারত, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু যেটুকু সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেটুকু কি করতে পেরেছে? চুক্তিতে নিয়োগের নীতি গ্রহণ করে সরকার শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীকে আরও কোণঠাসা করছে। বহু কর্মীকে অতি সামান্য বেতনে কাজ করাচ্ছে। অনেক সময়েই তা এমন কাজ, যা এক জন পুরো সময়ের কর্মীর করার কথা। প্যারাটিচারের কাজ করছেন, পিয়ন করছেন কেরানির কাজ, স্বাস্থ্যকর্মী চিকিৎসা চালাচ্ছেন। কখনও বা স্বল্প ‘সম্মানদক্ষিণা’ দিয়ে অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্বহাল করা হচ্ছে। তিন-চার হাজার টাকা মাইনের অস্থায়ী কর্মী দিয়েই যখন দফতর চলছে, তখন নতুন নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া কেন? বেকারের তো অভাব নেই। স্থায়ীকর্মীর চাইতেও কয়েক গুণ বেশি খাটিয়ে অফিসে, স্কুলে, আদালতে, থানায় নামমাত্র বেতনের লোক পুষছে সরকার।

ফলে সমান কাজ করেও সমান বেতন জুটছে না। রোজগারে অসাম্য বাড়ছে, যা সমাজে অস্থিরতার এক প্রধান কারণ। কিন্তু আরও বড় ক্ষতি হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। পড়াশোনা করলে, পরিশ্রম করলে, নিজেকে তৈরি করতে পারলে জীবনে উন্নতি হবে— এই বিশ্বাস জীবনের ভিত্তি। দাঙ্গা থেকে দেশভাগ, বহু সঙ্কটের সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রত্যয়ে বাংলার কিশোর-তরুণ প্রজন্ম ভেঙে না পড়ে, ভেসে না গিয়ে, এগিয়ে গিয়েছে। এই আস্থা যদি টলে যায়, যদি মনে হয় যে পরিশ্রম তার উচিতমূল্য পাবে না বাজার বা রাষ্ট্রের থেকে, যখন ধনঞ্জয় আর অনুভাদিরাই ‘দৃষ্টান্ত’ হয়ে দেখা দেয়, তখন অন্য এক সঙ্কট জন্ম নেয়। তার চিহ্ন আজ চার দিকে। যথেষ্ট কাজ তৈরি না করা, কিংবা নামমাত্র বেতনে কাজ করানোর কী মূল্য দিতে হবে দেশকে, তার হিসেব কে কষবে?

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement