শত্রুপক্ষের লেখা উপন্যাস এই পুজোয় রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেললাম। শত্রু মানে, কানাডার তরুণী ম্যাডেলিন থিয়েন। তাঁর বাবা মালয়েশিয়ার চিনা, মা হংকং-এর। মাও জে দং-এর রাজত্বের শেষ দিকে, ১৯৭৪ সালে এই পরিবারটি চিন থেকে কানাডায় এসে থিতু হয়। সেখানেই ম্যাডেলিনের জন্ম। চিনা বংশোদ্ভূত যখন, শত্রু তো বটেই— জাতীয়তাবাদী ভারতে সে কথা না মানলে গর্দান যেতে পারে।
ম্যাডেলিনের নতুন উপন্যাস ‘ডু নট সে উই হ্যাভ নাথিং’ এ বার বুকার প্রাইজের চূড়ান্ত পাঁচ বাছাইয়ের একটি। শিকে ছিঁড়ল কি না, জানা যাবে আজ বিকেলে।
না ছিঁড়লেই বা কী যায় আসে! বুকার ছাড়াও এই উপন্যাস ইতিমধ্যে কানাডায় গিলার প্রাইজ, আমেরিকায় কার্নেগি পদকের অন্যতম বাছাই। কম্বোডিয়ায় পল পটের গণহত্যার প্রেক্ষিতে লেখা ম্যাডেলিনের আগের উপন্যাস ‘ডগস অ্যাট দ্য পেরিমিটার’ এ বছরই ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় সেরা ইংরেজি উপন্যাস হিসেবে সম্মানিত।
কম্বোডিয়া নয়, ৪৬৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস চিনের তিন প্রজন্মের সঙ্গীতকারদের নিয়ে। প্রথম প্রজন্ম চল্লিশের দশকে আমাদের দেশের যাত্রা পার্টির মতো ঘুরে ঘুরে গান গায়। সে এক অশান্ত সময়। কোনও গ্রাম আজ জাপানিদের দখলে, আগামী কাল কুয়োমিনটাংয়ের, পরশু কমিউনিস্টদের হাতে, পরের দিন ফের হিসেব পাল্টে যায়।
অতঃপর বিপ্লব, মাও জে দং এলেন ক্ষমতায়। ঠিক হল, বেঠোফেন, মোৎসার্ট— যে নামই আওড়াও না কেন, রেডিয়োতে পার্টির বাছাই করা ১৮টি ‘বিপ্লবী অপেরা’ ছাড়া অন্য কোনও পাশ্চাত্য সঙ্গীত বাজবে না। উপন্যাসের নামও সেই বিপ্লবী চিনের জাতীয় সঙ্গীত থেকে নেওযা। শিয়ান জিংহাই লিখেছিলেন সেই গান: ‘পুরনো দুনিয়া ধ্বংস হোক, ক্রীতদাসেরা জাগো/ কখনও বোলো না আমাদের কিছু নেই।’
বিপ্লবী গানের এই ‘অচ্ছে দিন’-এর পরই এল দ্বিতীয় প্রজন্মের সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সাংহাই কনজারভেটরি-র ৫০০ পিয়ানো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওযা হল, ডিরেক্টরকে নিয়ে যাওযা হল শ্রমশিবিরে। ছাত্ররা তখন শিক্ষককে রাস্তায় পিটিয়ে শুইয়ে দেয়, ‘বলুন, আমি গণশত্রু। বলুন আমি ছাত্রদের মনে বিজাতীয় চিন্তা ঢুকিয়ে দেশের সর্বনাশ করছি।’ ভলতেয়ার ও বালজাক অনুবাদ করে বিপ্লব শুরুর দিনগুলিতে দেশবাসীর শ্রদ্ধার্হ হয়েছিলেন ফাউ লেই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে সস্ত্রীক পাঠিয়ে দেওয়া হল জেলে। কারণ, তাঁদের সন্তান, সঙ্গীতকার ফাউ সং ইহুদি মেনুহিন-এর মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশদ্রোহীর গুষ্টি না হলে এ রকম করতে পারে?
এল তৃতীয় প্রজন্ম। ক্ষমতায় দেং জিয়াও পিং। সাংস্কৃতিক বিপ্লব আর শ্রমশিবিরের দিনগুলির ‘পরিবর্তন’ ঘটে গিয়েছে। পাঁচশো পিয়ানো যেখানে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেই সাংহাই কনজারভেটরি ফের নতুন ভাবে গড়ে তেলার চেষ্টা হচ্ছে। লোকে ইচ্ছা মতো গান শুনতে পারে, গাইতে পারে। দেং বলে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বার মেধার ভিত্তিতে ভর্তি। কমিউনিস্ট পার্টির কোটা থাকবে না।
কিন্তু ১৯৮৯? রেডিয়ো জানাল, সকাল ৭টা ৫৯ মিনিটে মারা গিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন প্রধান হু ইয়াও বাং। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জুলুমশেষে তিনিই তো সাধারণ মানুষকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে তাঁর মরদেহে পুস্পস্তবক অর্পণ করতে এসে ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন তুলল, ‘সরকার আমার সম্পর্কে গোপন ফাইল রাখবে কেন? কী অধিকার আছে তার?’ বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ছড়িয়ে দিল প্যামফ্লেট: কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি দশটি নিরীহ প্রশ্ন। চিনের আধুনিকীকরণ প্রকল্পে দেং জিয়াও পিং চারটি স্তম্ভের কথা বলেছিলেন: কৃষি, শিল্প, জাতীয় সুরক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। ছাত্রদের প্রশ্ন: ‘কিন্তু গণতন্ত্র? স্বাধীনতা? এই পাঁচ নম্বর স্তম্ভটা ছাড়া সব আধুনিকীকরণ ফাঁপা বুকনি।
তিয়েন আন মেনে সে দিন ছাত্রছাত্রীদের হাতে দেংয়ের পুরনো বক্তৃতারই প্ল্যাকার্ড: ‘বিপ্লবী সরকারের কাজ জনতার কথা শোনা।’ পার্টির আর এক নেতা ঝাও জিয়াংও বিবৃতি দিয়েছেন, অচিরেই অনশনরত ছাত্রদের সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসব। কোথায় কী? পর দিন ভোররাতে ব্রিজ পেরিয়ে তিয়েন আন মেনের দিকে ছুটে আসে সাঁজোয়া গাড়ি। বিভিন্ন সেতুতে আর রাস্তার মোড়ে গড়ে তোলা গণপ্রতিরোধ চুরমার। ঝাও জিয়াং-এর খবর নেই, তিনি গৃহবন্দি। বেজিংয়ের পুরো রিং রোড ঘিরে ফেলেছে সামরিক ট্যাঙ্ক। উপন্যাসের নায়ক তারই মধ্যে রচনা করে তার জীবনের একমাত্র সিম্ফনি: দ্য সান শাইনস অন দ্য পিপলস স্কোয়ার।
উপন্যাসটা যখন পড়ছিলাম, জানতাম না, প্রতিবাদী এক সঙ্গীতকারই হবেন এ বার সাহিত্যের নোবেল বিজেতা। কিন্তু মনে আছে অষ্টমী, নবমীর দিনগুলোয়, যখন এই আখ্যানে ডুবে আছি, রাস্তায় নতুন জামা-জুতোর ভিড়, পাড়ার মণ্ডপে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু’, আর সোশাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়ছে, ‘চিন পাকিস্তানের সমর্থক, চিনের তৈরি আতসবাজি বয়কট করুন।’ চিনা রাষ্ট্রপ্রধান শি চিনফিং পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিতে রাজি হননি, ফলে সকলের রাগ আছড়ে পড়ছে। এক বার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি, চিনের বাজি না কিনে শিবকাশীর শিশুশ্রমিকদের তৈরি বাজি কিনলে দেশের কোন উপকার হবে? কিন্তু ইচ্ছা হল না। তখন হৃদি ভেসে যায় পীত নদীর জলে।
হৃদয় বুঝে গিয়েছে, কানাডার বাসিন্দা এই চিনা লেখিকা একেবারেই শত্রুশিবিরের। নইলে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ওই ভুলভাল কথাগুলি হাইলাইট করা হয়! গণতন্ত্র ছাড়া জাতীয় সুরক্ষাও নাকি ধাপ্পাবাজি! লেখিকা জানেন না, গণতান্ত্রিক দেশের মিডিয়াতেও ‘ওয়ার রুম’ থাকে, সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর বেশির ভাগই প্রশ্নহীন আনুগত্যে জাতীয় সুরক্ষাকে প্রথম স্থানে বসায়। ধারণাগুলিও তো বদলে গেল। এত দিন জানতাম, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বাড়াবাড়ি কমিউনিস্টদের একচ্ছত্র জমানাতেই হয়। কিন্তু উপন্যাস তো অন্য কথা বলছে। যখন ছাত্ররা দাদাদের উস্কানি পেয়ে শিক্ষককে কান ধরে ওঠবোস করায়, আমজনতা এইটা বিজাতীয়, ওটা বিদেশি চিন্তা, তাই দেশের পক্ষে বিপজ্জনক বলে শোর মচাবে, সেটাই ভয়ঙ্করতার শুরু।
সবচেয়ে ভয়ঙ্করটি অন্যত্র। উপন্যাসের নায়ককে সিম্ফনি বাজাতে না দিয়ে শ্রমশিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে কোনও প্রশ্ন করে না। গান ভুলে, বউ-বাচ্চা সমেত সাধারণ শ্রমিক হয়ে বেঁচে থাকে। ‘বেঁচে থাকা মানে রাগের বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং ভিতরে ভিতরে সেই রাগ নিঃশব্দে পুষে, ক্ষয়ে যাওয়া।’ এটাই আমাদের, ছাপোষা মানুষদের ইতিহাস। কেউ বিপ্লব, কেউ পরিবর্তন, কেউ বা অচ্ছে দিন-এর ঐতিহাসিক স্লোগান দেবে। কিন্তু দিনের শেষে সেই সব বড় ইতিহাসের ট্যাঙ্ক আর কামান তোমাকেই গুঁড়িয়ে চলে যাবে। কেউ জানবে না, রাগের শীতল আগুনে পুড়ে যেতে যেতে কী ভাবে বেঁচে আছো তুমি!
বলেছিলাম না, শত্রুপক্ষের উপন্যাস! এই গা ছমছমে অনুভূতি শত্রু ছাড়া কে বা দিতে পারে!