Coronavirus Lockdown

দুর্যোগ আতঙ্কিত করলেও মোছে না অক্ষর, ভালবাসা

উত্তরই হোক বা দক্ষিণ, সব পথ এসে মেলে বইপাড়ায়। ঝড় তাকে ভূলুণ্ঠিত করলেও বেঁচে থাকে পুরনো বইয়ের গন্ধ, অচেনাকে চেনার, জানার চিরকালীন আনন্দ। লিখছেন রচনা মজুমদার‘ঠাকুমার ঝুলি’র লেখকের পদবি দেখে প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম, আমার পদবিও ছাপা অক্ষরে থাকতে পারে!

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২০ ০১:৫২
Share:

বাইরের বই বলতে যা বোঝায়, সেটার শুরু আমার ‘ঠাকুমার ঝুলি’ আর ‘ক্ষীরের পুতুল’ দিয়ে। এর আগে হাসিখুশি বইটাকে গল্পের বই বলা যেত বটে, কিন্তু নিয়মমাফিক পড়তে হত বলে কখনও ছুটির বইয়ের তকমা দিতে পারিনি। ‘ঠাকুমার ঝুলি’ আমার প্রথম গল্পের বই, বাবা এনেছিলেন কলেজ স্ট্রিট থেকে। আর ‘ক্ষীরের পুতুল’টা উপহার দিয়েছিলেন বাবার এক বন্ধু। দু’টো বই-ই আমার প্রিয় ছিল, তবে আলাদা কারণে।

Advertisement

‘ঠাকুমার ঝুলি’র লেখকের পদবি দেখে প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম, আমার পদবিও ছাপা অক্ষরে থাকতে পারে! শুধু মাঝের ‘মিত্র’টা নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল। আর ক্ষীরের পুতুলের চোখ জোড়ানো রঙিন জগৎ আমায় খুব করে টানত। দুয়োরানির ওই সাদামাটা বেশভূষা আমার ভাল লাগত না মোটেই। লাল কালি দিয়ে তাই সুন্দর করে সাজিয়ে দিতাম রানিকে। সাজাতাম বাঁদরটাকেও।

এই দু’টো বই পড়ে পড়ে যখন চিবিয়ে ফেলেছি, তারপর শুরু করেছিলাম ‘রাজকাহিনি’। তবে বইটা শেষ করিনি। তার আগেই ধরে ফেলেছি ‘বুড়ো আংলা’। তারপর আবার স্কিপ করেছি টুনটুনির বইতে। ‘এক টুনিতে টুনটুনাল/ সাত রানির নাক কাটাল’— এইটাই খুশি করত সব চেয়ে বেশি। ওইটুকু পাখির এই অসীম ক্ষমতা দেখে শিউরে উঠতাম। সবই বাবার দেওয়া। প্রথম পাতায় লেখা থাকত— ‘বুড়িকে বাবা, কলেজ স্ট্রিট, ৫/৩/২০০০’ তারিখের বদল হত কেবল।

Advertisement

তখন আমাদের ওখানে আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হত অনেক। আমার সব সময় লোভ ছিল পুরস্কারের উপর। মেডেল পেলে খুশি হতাম না মোটেই। খুশি হতাম বই পেলে। একটা একটা করে জমাতাম, এগুলো আমার বই। এ ভাবেই একদিন পেয়ে গেলাম গোটা সুকুমার সমগ্র। ঠিক মা যে ভাবে এক পায়ের উপর আর এক পা দিয়ে বই পড়তেন, আমিও ঠিক তেমনটাই করতাম।

পুজোর সময় বাড়িতে আসত আনন্দমেলা, কিশোরভারতী, শুকতারা। তখনও রবীন্দ্রনাথকে সহজপাঠের বাইরে চিনি না। বরং তখন বীরবলই বীরপুরুষ। তার আর গোপালভাঁড়ের কাণ্ডকারখানা মুখস্থই করতাম বলা চলে। বুঝে গিয়েছিলাম, পড়াশোনা আমার জন্য নয়।

এর পর আস্তে আস্তে বড় হলাম। তার মাঝেই একদিন বেধরক মার খেলাম। অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ। তখনও রেজাল্ট বার হয়নি। কিনতে গিয়েছি সমরেশ বসুর ‘বিবর’। ধরা পড়লাম, মার খেলাম আর তার মাঝেই শুরু হয়ে গেল বইপাড়া আর একটা ষোড়শী মেয়ের প্রেম। কলেজ না গিয়ে চলে গিয়েছি কলেজ স্ট্রিটে। পুরনো বইয়ের দোকান থেকে ‘এক্ষণ’, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কোরক’— পুরনো পুজোসংখ্যার ভয়াবহ নেশা তখন। বন্ধুরা মিলে লিটল ম্যাগাজিন তৈরি করছি। রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, পটুয়াতলা লেনে তখন নিত্য যাতায়াত। মন দিয়ে দেখতাম মুদ্রণ, প্রুফ রিডিং, বাঁধাই। তারপর কলেজ স্ট্রিটেই শুরু হল পড়াশোনা। আরও পাকাপোক্ত হল আমার আর বইপাড়ার সম্পর্ক, মানে ম্যাচিওরড রিলেশনশিপ বলতে যা বোঝায় তাই। বই বাঁধাই, বই বাছাই, বই খোঁজা, পকেট ফাঁকা থাকলে বইতে চোখ বোলানো, বই-চিত্রতে সেমিনার— সব বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল বই পাড়া। আমিটা শুধু আমি তো নয়। এমন বহু আমির আবেগের আরেক নাম কলেজ স্ট্রিট।

যে কোনও সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে এ যাবৎ কাল ঝড়ই তো এসেছে। তেমনই এল। ২০ তারিখ। জলে ভেসে গেল কত সব বই। কোটি কোটি টাকা লোকসান। ক্ষতিগ্রস্ত বই শুকোনো হল এই আশায়, যদি কোনও ভাবে ওজন দরে বিক্রি করা যায়। ওজন! আবেগের ওজন! এমনিতেই দু’মাস বইপাড়া বন্ধ। থমকে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা। তার ওপর আবার বিপর্যয়, কঠিন সময়ে এমনটাই হয় বোধহয়। এক মুহূর্তের জন্য একটা ঝটকা খেল সবাই। ওই চোখে অন্ধকার দেখা যেটাকে বলে, বোধ হয় সেরকমই কিছু।

‘যে মেয়েটা দূরের একটা ছোট শহর থেকে একা একা গিয়েছল শহরটায়, বন্ধু-বান্ধব দাদা-দিদি এ সব হওয়ার আগেই ঘিরে ধরেছিল পুরনো বইয়ের গন্ধ আর উত্তুরে গলির গন্ধ, মেয়েটা আজও সেই গন্ধ মেখে বাঁচে অনায়াসে। এক একটা দিন সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে রাত নামতে দেখেছি। অনায়াসে চোখ বন্ধ করে শঙ্ককরদার চা দোকান থেকে হেঁটে যেতে পারব প্যারামাউন্টে। ২০ তারিখের ঝড়ের পর একের পর এক ভেসে যাওয়া শহরের ছবি দেখেছি। সেখানে বেশি দিন জল জমে থাকতে দেওয়া যাবে না।’— এই আবেগ রিয়া পাত্রের মতো আরও অনেক অনেক মানুষের। হেমতাবাদ ব্লকের শাসন হাইস্কুলের শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় দত্ত বলেন, ‘‘স্কুল ও কলেজ-জীবনে পড়াশোনার বই কেনার জন্য কতবার যে কলেজ স্ট্রিটে গিয়েছি, তা মনে করতে পারছি না। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পরীক্ষার বইও সেখান থেকে কেনা। সেই জায়গা ডুবে যাবে! ভাবতে পারি না!’’ তবে তাঁরা শুধু আবেগ নিয়ে বসে থাকেন না। বইকে বাঁচাতে, বইপাড়াকে বাঁচাতে প্রত্যেকেই এক একজন যোদ্ধা হয়ে ওঠেন। যাঁরা জানেন ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। কী বিপুল সম্ভাবনা তাঁদের চোখেমুখে! জানেন, সময়টা ঠিক কাটবেই। কত আয়োজন। কেউ বই, কেউ নিজের আঁকা ছবি, নিজের লেখা, নিজের শিল্প সব, সব বিক্রি করে দিচ্ছেন। না, নিজের জন্য নয়। নিজের সব আবেগের জন্ম যেখান থেকে, সেই উৎসকে বাঁচাতে।

অল্প বৃষ্টিতে কলেজ স্ট্রিটকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানতেন, এই ঝড়ের পরে কী হবে! ঝড়ের আগে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। কিন্তু পরেরটা সামলে নিলেন তাঁরাই।

কলেজ স্ট্রিট। এশিয়ার বৃহত্তম বইয়ের পসরা। বইকেন্দ্রিক কত জীবিকা। কত জীবন। মরে গেল কত বই! ভেসে গেল কত! আর বাকিরা? ওরা বাঁচবে। কিলো দরে বিক্রি হবে না আর একটাও পাতাও। মুছবে না অক্ষর। বাঁচবে ভালবাসা, বাঁচবে ভাবনা। কারণ তো ওই একটাই— ‘যত বার পরাজয় তত বার কহে, আমি ভালবাসি যারে সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে’!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement