সম্পাদকীয় ১

‘টেররিস্তান’

রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে যখন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের ফার্স্ট সেক্রেটারি গম্ভীর পাকিস্তানকে ‘টেররিস্তান’ বলিয়া অভিহিত করিলেন, এবং মুক্তকণ্ঠে দৃপ্তভাষায় সে দেশের সন্ত্রাস-বিষয়ক দ্বিচারিতাকে আক্রমণ করিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:৩২
Share:

মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝিলে হাত খুলিয়া মারাই ভাল। ছক্কা লাগিয়া গেলে কথাই নাই, না লাগিলেও কিছু রান পকেটে আসিবেই। গত কিছু কাল যাবৎ পাকিস্তান বিষয়ে ভারত এই নীতি লইয়া চলিতেছে। যে কোনও সুবিধাজনক অবকাশ পাইলেই পাকিস্তানকে এক হাত লইতেছে। সুতরাং রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে যখন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের ফার্স্ট সেক্রেটারি গম্ভীর পাকিস্তানকে ‘টেররিস্তান’ বলিয়া অভিহিত করিলেন, এবং মুক্তকণ্ঠে দৃপ্তভাষায় সে দেশের সন্ত্রাস-বিষয়ক দ্বিচারিতাকে আক্রমণ করিলেন। পর দিন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ স্বয়ং নজিরবিহীন আক্রমণে বলিলেন, ভারত আইআইটি তৈরি করে, পাকিস্তান তৈরি করে লস্কর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রিকস সম্মিলন এবং হার্ট অব এশিয়া বৈঠক, এই বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পরিবেশের সুযোগ লইয়াই ভারতের এই আক্রমণ। ইহা কোনও ঘটনাচক্র নয় যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের আখড়া বলিতেছেন, ভারতও সেই সময়ই পাকিস্তানের উপর তীক্ষ্ণ আক্রমণ শানাইতেছে। গত বৎসরও দিল্লি সন্ত্রাসের ‘আইভি লিগ’ বলিয়া পাকিস্তানকে অভিহিত করিয়াছিল, রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায়। এ বার আক্রমণ আরও প্রত্যক্ষ, আরও তীক্ষ্ণ, কঠোরতর শব্দে সজ্জিত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি এত দীর্ঘ ও সংহত আক্রমণ রাষ্ট্রপুঞ্জে সুলভ নহে। পাকিস্তান পর দিনই উত্তর দিবার চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের স্থায়ী পাক দূত মালিহা লোদী একটি ভুয়া ছবি দেখাইয়া ভারতের কুৎসা করিবার চেষ্টা করিয়া হাতেনাতে ধরা পড়িয়া যাওয়ায় উল্টো ফল হইয়াছে। ঘটনার জের অনেক দূর গড়াইবার সম্ভাবনা। তবে তাহাতে ভারতের মঙ্গল না অমঙ্গল, জোর দিয়া বলা যায় না।

Advertisement

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই ভিত্তিহীন নয়। এক মুখে সন্ত্রাসবিরোধিতার যুদ্ধে শামিল হইবার প্রতিশ্রুতি, অন্য মুখে ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয়ের আশ্বাস, কিংবা লস্কর-ই-তইবার হাফিজ মহম্মদ সইদকে রাজনীতিমঞ্চে নেতা হিসাবে অভিষিক্ত করিবার অভয়বাণী— এই সব কাণ্ড দেখিবার পর পাক রাষ্ট্রের সহিত সন্ত্রাস-কারিগরির ঘনিষ্ঠ যোগ লইয়া মন্তব্য সম্পূর্ণ সংগত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে লস্কর-ই-তইবা ইতিমধ্যেই জঙ্গি সংগঠন বলিয়া চিহ্নিত। অথচ হাফিজ সইদ পাকিস্তানে জঙ্গি নেতা হইতে রাজনৈতিক নেতায় পুনর্বাসিত হইতেছেন। ভারত আপত্তি তুলিতেই পারে। বিশেষত পাকিস্তান যেহেতু নিজের দোষ চাপিতে এখন ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উৎকণ্ঠা দেখাইবার পন্থা লইয়াছে, ভারতের গা-জ্বালা স্বাভাবিক।

কথা হইল, কূটনীতিতে গা-জ্বালা মিটাইবার কাজটিও সতর্কতার সহিত করা দরকার। ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ মহাভারতের মতোই চিরবহমান, সুতরাং পাকিস্তানের জঙ্গি-সংযোগ লইয়া অন্য দেশের মন্তব্য, এবং ভারতের মন্তব্যের মধ্যে পার্থক্য অনেক। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলির পক্ষ হইতে সমালোচনা শুনিলে ইসলামাবাদ যদি বা কিয়ৎ পরিমাণেও আত্মসমালোচনায় সময় দেয়, ভারতের অভিযোগ তাহাকে আবার নিরস্ত করিয়া দিবে, নিজের জেদে অটল থাকিবার প্রতিজ্ঞায় ফিরাইয়া দিবে। কেননা, ভারতের চাপের সামনে নতি স্বীকার পাকিস্তানের কোনও সরকার, কোনও রাজনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠী প্রাণ থাকিতে করিতে পারে না। তাই অন্যান্য দেশ ইসলামাবাদকে বকিলে দিল্লি খানিক কৌশলপূর্ণ নীরবতা রাখিলেই বোধহয় ভারতের স্বার্থ কিছুটা আগাইত। ভারত-পাকিস্তান শত্রুতার মনস্তাত্ত্বিক দিকটি ভূ-রাজনীতিক দিকের চেয়ে বেশি জটিল। এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বৈরথের চরিত্র বুঝিয়া পদক্ষেপ করিবার মধ্যেই কূটনীতির কূটতা। মোদীর বিজেপিমার্কা তীব্র পাকিস্তানবিরোধিতার কূটনীতিতে সেই সব সূক্ষ্ম কূটতার জায়গা নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement