Diego Maradona

ব্যক্তি-গাথা

মারাদোনা সেই ‘অন্য’ পৃথিবীর জনপ্রিয়তম নায়ক। ফুটবল-প্রতিভার স্ফুরণ ছাড়াইয়া তিনি লোকগাথা— অফুরান, অনশ্বর। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২০ ০১:১০
Share:

১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতার পরে ট্রফি নিয়ে আর্জেন্টিনার নায়ক দিয়েগো মারাদোনা। ফাইল চিত্র।

সেই ১৯৮৬ সালের ২২ জুন। মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড এবং আর্জেন্টিনা ম্যাচে সেই ‘ভগবানের হাত’ গোল, এবং তাহার পর শুরু সেই ঐতিহাসিক দৌড়। ইংল্যান্ডের একের পর এক খেলোয়াড়কে কাটা‌ইয়া মারাদোনা যখন সেই ষাট মিটারের রূপকথার দৌড় শেষ করিলেন, বল তখন ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হইয়া জালে জড়াইয়া গিয়াছে। স্তম্ভিত ধারাভাষ্যকার প্রায় কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেছেন, ‘ঈশ্বর, কী দেখাইলে! কোন গ্রহ হইতে আসিয়াছ তুমি দিয়েগো!’ সেই এক অবাস্তবের বাস্তবায়ন দেখিয়াছিল বিশ্বদুনিয়া। দেখিয়াছিল যাহা, সেই বিশ্বকাপে দিয়েগো মারাদোনা দেখাইয়াছিলেন যাহা— তাহার নির্যাস একটিই: গ্রহান্তর নহে, এই জলকাদামাটির পৃথিবীতেই বিরাট পার্থক্য গড়িয়া দিতে পারে একক ক্ষমতা ও প্রতিভার স্ফুরণ। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, প্যারিসের মতোই বুয়েনোস আইরেসের নামও যে সে দিন হইতে সাধারণ জ্ঞানের অভিধানে ঢুকিয়া গেল, তাহার পিছনে কেবল এক ব্যক্তি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকাকে চিনাইয়া দিবার পিছনেও সেই এক ব্যক্তি। সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের কাছে আন্তর্জাতিক ফুটবল ময়দানে পেলের দেশ ব্রাজিলকে সমর্থন করাই ছিল ধর্মের ন্যায়, সেই একেশ্বরবাদকে টলাইয়া দিবার পিছনেও একই ব্যক্তি। অথচ মারাদোনার আগেও আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতিয়াছে। সামরিক শাসক হুয়ান পেরনের রাজত্বে ১৯৭৮-এর সেই জয় বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত অধ্যায় হইয়া থাকিয়াছে। সেই বারের অধিনায়ক পাসারেল্লা বিশ্বকাপ জিতেও ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়াসনটি দখল করিতে পারেন নাই। মারাদোনা প্রায় একার কৃতিত্বে তাহা পারিলেন।

Advertisement

অন্য দিকে তখন আর এক ইতিহাস রচনা হইতেছে ইটালির নেপলস-এ। ইটালির উত্তর ও দক্ষিণের লড়াইয়ে ব্রাত্য ও নিন্দিত এই শহরের ক্লাবটিকে মারাদোনা সাফল্যের শিখরে লইয়া গিয়াছিলেন সম্পূর্ণ একক নৈপুণ্যে। তাহার অভিঘাত ছিল এমনই যে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে এই শহরে ইটালির সহিত আর্জেন্টিনার খেলায় গোটা মাঠের সমর্থন আছড়াইয়া পড়িল তাহাদের নয়নের মণি দিয়েগোর প্রতি, নিজের দেশের বিরুদ্ধে যাইয়া! মারাদোনার বল-প্লের মূর্ছনা আর তাহা আটকাইবার জন্য বিপক্ষের কুৎসিত ফাউল এমন ভাবে আলোড়িত করিল সারা পৃথিবীকে যে, ফুটবল নিয়ামক সংস্থা বাধ্য হইল ফাউলের নিয়ম পাল্টাইতে। মারাদোনা তাই শুধু ফুটবলার নহেন, তিনি একটি যুগ। জনমনে তাঁহার আবেদন, শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি এমনই প্রশ্নাতীত যে, বিতর্কের বরপুত্র হওয়া সত্ত্বেও— হাত দিয়া গোল, ডোপিং বা মাদকের কলঙ্ক তাঁহার জনপ্রিয়তায় এতটুকু ছায়া ফেলিতে পারে নাই। বেন জনসন বা মাইক টাইসনদের সহিত এইখানেই তাঁহার মস্ত তফাত।

পেলে অবসর লইবার ঠিক পর পরই মারাদোনা আসিয়াছিলেন। বহু বিখ্যাত ফুটবল তারকা আসিয়াছেন, আসিবেন, পরিসংখ্যানে হয়তো পেলে-মারাদোনাকে ছাপাইয়াও যাইবেন কেহ কেহ। মেসি-রোনাল্ডো-রোনাল্ডিনহো-নেমারদের ভক্তসংখ্যা মাথার গুনতিতে হয়তো মারাদোনার অপেক্ষা কম হইবে না, কিন্তু আবেগের বিস্ফারে মারাদোনাকে হারানো শক্ত হইবে। কারণ ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি এবং তৎ-পরবর্তী বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আশা-আকাঙ্ক্ষা-উদ্দীপনার গড়নটাই বদলাইয়া গিয়াছে। জাতিরাষ্ট্রের সেই পুরাতন চেহারা আর নাই। উপনিবেশোত্তর যুগে কখনও বিশ্বকাপের আসরে, কখনও অলিম্পিকের স্টেডিয়ামে তথাকথিত অনুন্নত দেশগুলি হইতে যখন খেলোয়াড়রা ঝলসাইয়া উঠিতেন, তাঁহাদের কেন্দ্র করিয়া পৃথিবীর সমস্ত দারিদ্র-দুর্গত, পিছাইয়া পড়া মানুষ তাঁহাদের জয় দেখিতে পাইতেন। তখন স্যাটেলাইট টিভি ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। গুগলায়িত বিশ্ব আজ অনেক দূর সরিয়া আসিয়াছে। অনেক বেশি পরস্পরের সহিত পরিচিত হইয়াছে দেশগুলি। কে কাহার অপেক্ষা সেরা, কাহার প্রতিশ্রুতি কতখানি ও কেন, তাহার চর্চা বাড়িয়াছে। আগের মতো হঠাৎ জাদুকরের আবির্ভাব আজ অভাবনীয়। তাই আজ জামাইকার উসেইন বোল্টকে সর্বকালের সেরা অ্যাথলিট মানা হইলেও আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ কার্ল লুইসকে লইয়া সে দিন যে হৃদয়োচ্ছ্বাস প্রবাহিত হইত, তাহার মধ্যে এক অন্য পৃথিবীর স্বপ্ন বোনা থাকিত। মারাদোনা সেই ‘অন্য’ পৃথিবীর জনপ্রিয়তম নায়ক। ফুটবল-প্রতিভার স্ফুরণ ছাড়াইয়া তিনি লোকগাথা— অফুরান, অনশ্বর।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement