Didi k Balo

বিকেন্দ্রিত 

পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক অতিকেন্দ্রিকতার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বই সর্বাধিক। সম্ভবত সহজাত প্রবৃত্তিবশেই তিনি ছোট-বড় যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজে করিতেই স্বচ্ছন্দ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:৪৮
Share:

—ফাইল চিত্র।

২০১৯ সালের তার বাঁধা হইয়াছিল ‘দিদিকে বলো’-র সুরে। ২০২০ শেষ হইল ‘পাড়ায় সমাধান’-এর কথা বলিয়া। এই দুইটিকে শুধুই দুইটি নির্বাচনমুখী জনসংযোগ প্রকল্প ভাবিবার যুক্তি আছে। তবে, তাহার বাহিরে, এই পরিক্রমার আরও একটি তাৎপর্য লক্ষ করিবার প্রয়োজনও আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার যে ভঙ্গিতে চলিতে অভ্যস্ত, ‘দিদিকে বলো’ প্রকল্পটি চরিত্রগত ভাবে তাহার সমানুবর্তী ছিল— এই রাজ্যে যে কোনও সমস্যার সমাধান করিতে পারেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী, এবং শুধু তিনিই সমস্যার সমাধান করিতে পারেন। ফলে, বৃহত্তম প্রশাসনিক দুর্নীতি হইতে পাড়ার মোড়ের কলে জল না আসা, সব সমস্যার জন্যই রাজ্যবাসী মুখ্যমন্ত্রীর শরণ লইতে চাহেন। ‘দিদিকে বলো’ প্রকল্পটি মানুষের সেই প্রবণতাটিকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেছিল। তাহার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থিত ‘পাড়ায় সমাধান’ প্রকল্পটি। তাহার মূল কথা, যে সমস্যাগুলি সাধারণ এবং সহজেই সমাধানযোগ্য, সেগুলিকে একেবারে প্রাথমিক স্তরেই সমাধান করিয়া ফেলা। অর্থাৎ, ২০১৯-এ যদি অতিকেন্দ্রীকরণের নীতি থাকে, ২০২০ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কথা ঘোষণা করিল। উভয় প্রকল্পেরই মূল কথা যে জনসংযোগ, তাহাতে সন্দেহ নাই— নির্বাচনী গণতন্ত্রে জনসংযোগের মাহাত্ম্য লইয়া প্রশ্নও নাই। কিন্তু, চরিত্রগত ভাবে প্রকল্প দুইটি এমনই বিপ্রতীপ যে অনুমান করা চলে, তাহার পিছনে একটি পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত আছে। মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত বুঝিয়াছেন, তাঁহার একার পক্ষে গোটা রাজ্যের দেখভাল করা অসম্ভব। তাহার প্রয়োজনও নাই। তিনিই সুপ্রশাসক, যিনি কাজ করাইয়া লইতে জানেন। অনুমান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো তাঁহার প্রশাসক সত্তার পরবর্তী স্তরে পদক্ষেপ করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন।

Advertisement

অনস্বীকার্য যে, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক অতিকেন্দ্রিকতার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বই সর্বাধিক। সম্ভবত সহজাত প্রবৃত্তিবশেই তিনি ছোট-বড় যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজে করিতেই স্বচ্ছন্দ। অনেক ক্ষেত্রে তাহাতে অতি দ্রুত কাজ হয়। কিন্তু, বহু অবাঞ্ছিত দীর্ঘসূত্রতার জন্মও হয় এই ভাবেই। ‘পাড়ায় সমাধান’ হিসাবে যে কাজগুলি এখন পাড়াতেই সারিয়া ফেলিবার কথা বলা হইতেছে, স্বাভাবিক ভাবে, সেগুলি প্রশসানের সর্বনিম্ন স্তরেই হইবার কথা। পুরসভা বা পঞ্চায়েত স্তরেই তাহা করণীয়। কিন্তু, প্রশাসনিক অতিকেন্দ্রিকতার কারণেই তাহা হইতেছিল না। নির্বাচনী জনসংযোগের তাগিদেও যদি সেই বিকেন্দ্রীকরণের কাজটি হয়, যদি প্রশাসনের প্রতিটি স্তর নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করিতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে রাজ্যের লাভ। তাহাতে শুধু যে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা গতিশীল হইবে, তাহাই নহে— পশ্চিমবঙ্গ এখনও অবধি মূলত যে অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পের উপর নির্ভরশীল, তাহারও সুবিধা হইবে।

যে রাজনীতি চরিত্রগত ভাবে ব্যক্তিনির্ভর— কোনও এক জন নেতা বা নেত্রীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাই যাহার চালিকাশক্তি— তাহার নেতৃত্বাধীন প্রশাসন অতিকেন্দ্রিকতার রোগে ভুগিবে, এই আশঙ্কা সর্বত্রই থাকে। ক্ষমতাসীন দল রেজিমেন্টেড বা শৃঙ্খলাবদ্ধ হইলে বিপদ তবুও কম, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের ন্যায় দলে সেই বাঁচোয়াটুকুও নাই। গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব, স্থানীয় স্তরের দখল লইবার প্রবণতা, তোলাবাজি ইত্যাদিকে ঠেকাইয়া রাখিতে তখন ভরসা শুধুই শীর্ষনেত্রী। আশা করা চলে, ‘পাড়ায় সমাধান’-এর ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলির কথাও মাথায় রাখিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিকেন্দ্রিত প্রশাসন ও চটজলদি সমাধান যে গতি আনিতে পারে, তাহা যাহাতে রাজনৈতিক ক্ষুদ্রস্বার্থের ঘোলা জলে হারাইয়া না যায়, তাহা নিশ্চিত করাও মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। এই নিয়ন্ত্রণের উপরই প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করিবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement