উত্তরাধিকার?

দেশের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী কোনও ‘বাজপেয়ী ডকট্রিন’ প্রণয়ন করেন নাই, কিন্তু ভারতবাসী অবগত যে বাজপেয়ীর সময়ে বৃহত্তর অর্থে দেশের কূটনীতিতে ও সঙ্কীর্ণতর অর্থে দেশের প্রতিবেশী-নীতিতে বড় মাপের সাফল্য দেখিয়াছিল, বহু সম্ভাবনাময়তা তৈরি হইয়াছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিদেশনীতির সরকারি অভিধা ‘মোদী ডকট্রিন’, বিশদ ও বিজ্ঞ গবেষণাগ্রন্থও এ বিষয়ে প্রকাশিত হইয়া গিয়াছে। বাস্তবিক, ক্ষমতাসীন হইবার পরমুহূর্ত হইতেই মোদী ভারতের বৈদেশিক নীতির উপর জোর দিয়াছেন, অবিচ্ছিন্ন ভাবে বিদেশ-সফর করিয়াছেন, বহু রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতার সহিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন করিয়াছেন, ভারতের সহিত সেই সব রাষ্ট্রের আদানপ্রদানকে নূতন আকার দিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ‘মোদী ডকট্রিন’ কী ও কেন, তাহার সম্ভবত সর্বাধিক সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ইহাই। তবে এই ‘ডকট্রিন’-এর ফলে ভারতের কী প্রাপ্তি হইল, তাহা লাভের খাতায় না কি ক্ষতির খাতায় গেল, এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া সহজ নয়। কথাটি আরও বেশি করিয়া উঠিতেছে সম্প্রতি প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর স্মৃতি-সূত্রেই। দেশের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী কোনও ‘বাজপেয়ী ডকট্রিন’ প্রণয়ন করেন নাই, কিন্তু ভারতবাসী অবগত যে বাজপেয়ীর সময়ে বৃহত্তর অর্থে দেশের কূটনীতিতে ও সঙ্কীর্ণতর অর্থে দেশের প্রতিবেশী-নীতিতে বড় মাপের সাফল্য দেখিয়াছিল, বহু সম্ভাবনাময়তা তৈরি হইয়াছিল। নরেন্দ্র মোদী বাজপেয়ীর উত্তরাধিকারী হইবার চেষ্টা করিতেছেন। কিন্তু তিনি বুঝিতেছেন না যে, উত্তরাধিকার কেবল বাগ্মিতার জোরেই তৈরি হয় না, গলার জোরেই নিশ্চিত হয় না। উত্তরাধিকার প্রমাণ করিতে পারে দেশের চলমান ইতিহাস। ইতিহাস বলিতেছে, বিদেশ নীতির মাপকাঠিতে মোদীর উত্তরাধিকার-তত্ত্ব বিলকুল বরবাদ হওয়া সম্ভব।

Advertisement

বাজপেয়ীর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের শোকবার্তাটিও এই বৈপরীত্য মনে করাইয়া দেয়। বর্তমানে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের যে চরম শীতলতা, তাহার প্রেক্ষিতে এই বার্তার উষ্ণতাই বৈপরীত্যের প্রমাণ। প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের জীবনাবসানের পর প্রতিবেশী দেশ হইতে শোকবার্তা আসিবে, ইহা স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের যে কোনও নেতার দেহাবসানের পর পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী তাঁহাকে নিজের দেশের ‘বন্ধু’ বলিয়া বর্ণনা করিবেন না। বাজপেয়ী দেখাইয়া দিয়াছিলেন, ১৯৯৮ সালে পরমাণু শক্তি পরীক্ষা করিয়া ১৯৯৯ সালেই মিত্রতার স্বাক্ষর হিসাবে লাহৌর পর্যন্ত শান্তির বাসযাত্রা সম্ভব— কার্গিল সত্ত্বেও এ কথা সত্য। তাঁহার পাকিস্তান-নীতির মধ্যে পাকিস্তানের মানুষ ও পাক সরকারকে আলাদা ভাবে দেখিবার চেষ্টা ছিল। নরেন্দ্র মোদী কিন্তু ভারত-পাক সম্পর্ককে ক্রমশ শীতলতর ও তিক্ততর করিতে পারিয়াছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীরকে ক্রমাগত বাজি রাখিয়া পরিস্থিতি জটিলতর করিয়াছেন। পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের নরম-কথোপকথনের নীতির সমালোচনা করিয়া কঠিন নীতি আনয়ন করিয়া কিছুমাত্র লাভ হইয়াছে, এমন দাবি মোদী হয়তো নিজেও করিবেন না।

রাষ্ট্র তাহার বন্ধু নির্বাচন করিতে পারে, কিন্তু প্রতিবেশী নির্বাচন করিতে পারে না— বাজপেয়ী বলিয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদী তাঁহার পূর্বসূরির এই পরামর্শে কানও দেন নাই। একের পর এক প্রতিবেশী গত চার বৎসরে ভারতের প্রতি বিদ্বিষ্ট হইয়াছে, ভারতের সহিত তাহাদের স্বার্থ-সংঘর্ষ প্রবলতর হইয়াছে। ষাটের দশকের পর এই প্রথম চিনের সহিতও ভারতের সম্পর্ক প্রায় যুদ্ধ-পরিস্থিতির দিকে আগাইয়াছে। ভুটান বা মলদ্বীপের মতো দেশগুলিও এখন দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিতেছে। নেপাল ও বাংলাদেশ শত্রু না হইলেও বন্ধুত্ব বাড়াইবার আগ্রহ দেখায় নাই। মায়ানমার সঙ্কটে ভারতকে বহু পিছনে ফেলিয়া চিন অনেক বেশি নম্বর তুলিয়াছে। সুতরাং, মোদী ডকট্রিন যাহাই হউক, তাহাকে সফল বলা চলে না। বাজপেয়ী ডকট্রিন-এর দূরদৃষ্টি ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞা গ্রহণ করিলে বরং সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement