অ্যাডলফ হিটলার এবং স্তালিন।—ফাইল চিত্র।
অ্যাডলফ হিটলারের বিশ্বখ্যাত আত্মজীবনী ‘Mein Kamhf’ বইটির ইংরেজি অনুবাদের হার্স্ট অ্যান্ড ব্ল্যাকেট সংস্করণটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। আর এক বিশ্বখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ ‘নিউ ইংলিশ উইকলি’-তে হিটলারের এই আত্মজীবনীর একটি পুস্তক পর্যালোচনা করেন। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’-এর লেখক অরওয়েল এই বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে কী লিখেছিলেন, তার কিছু অংশের অনুবাদ পাঠকের জন্য তুলে ধরতে চাই।
অরওয়েল লিখেছেন, ‘প্রথমে হিটলার ছিলেন মানুষের কাছে এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। হিটলার জার্মান শ্রমিক আন্দোলনকে একদম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন, এ জন্য সম্পত্তিবান ধনী শ্রেণি তাঁকে অন্য সব বিষয়ের জন্য ক্ষমা করে দিতে প্রস্তুত। বাম ও ডান, দু’পক্ষই মনে করেছে, জাতীয় সমাজতন্ত্র হল রক্ষণশীলতার মতাদর্শের একটি দিক।
এর পর হঠাৎই ধারণায় এল এক ব্যাপক পরিবর্তন। অরওয়েল আরও লিখেছেন, ভাবুন, হিটলারের কর্মসূচি যদি কার্যকরী হত, তবে মস্তিষ্কহীন এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠত। যেখানে যুবকদের, অন্য কিছু নয়, শুধু যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। কামানের গোলার অন্তহীন উৎপাদন হয়ে চলত।
অ্যাডলফ হিটলার।—ফাইল চিত্র।
অরওয়েল বলেছেন, ‘এ কথা আমি অন রেকর্ড বলতে চাই, হিটলার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রথমে তাঁকে অপছন্দ করবার কোনও কারণ আমিও খুঁজে পাইনি। আবার কিছু দিনের মধ্যেই মনে হতে লাগল, খুব কাছাকাছি পেলে আমি ওঁকে হত্যা করতাম। কিন্তু ঘটনা হল, ওঁর মধ্যে একটা প্রচন্ড আবেদন আছে। তাই কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষও খুঁজে পাইনি।’ হার্স্ট অ্যান্ড ব্ল্যাকেট-এর সংস্করণে প্রকাশিত হিটলারের খাকি জামা পরা নবীন বয়সের ছবি দেখলে এই দুর্বলতা তৈরি হয়। ছবিটা প্যাথেটিক। কুকুরের মতো মুখ, কিন্তু ছবিটা একটা নিপীড়িত মানুষের ছবি। নানা রকম অন্যায় হয়েছে তাঁর শৈশবে। আত্মজীবনী পড়লে জানা যায়, শৈশব থেকে নানা অন্যায় অবিচারের শিকার হয়ে হিটলার গোটা পৃথিবীর উপরেই যেন রেগে আছেন। তাই তিনি যেন শহিদ। প্রমেথিউসের মতো।’
এর পরেই লিখেছেন সেই মোক্ষম বাক্যটি। হিটলার যদি একটি ইঁদুর মারেন তা হলেও তার প্রচারে মনে হবে তিনি একটা ভয়ঙ্কর ড্রাগন মেরেছেন।
হিটলার তাঁর আনন্দহীন মনের জন্য, মানুষের জন্য অন্য ভাবে ভেবেছেন। সাধারণত মানুষ নিরাপত্তা চায়, স্বাচ্ছন্দ্য চায়, কাজ করার সময়সীমা কমাতে চায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ চায়, পরিচ্ছন্নতা চায়। কিন্তু মানুষ লড়াই সংঘর্ষও চায়, আত্মত্যাগ চায়। হিটলার সেই অন্য পথে যান। অরওয়েল লিখেছেন, হিটলার বলেছেন, আই অফার ইউ স্ট্রাগল, ডেঞ্জার অ্যান্ড ডেথ। আর এ কথায় গোটা জাতি ওর পায়ে পড়ে গেছে কষ্ট করার জন্য। হিটলারের স্লোগান ছিল, গ্রেটেস্ট হ্যাপিনেস অব দ্য গ্রেটেস্ট নাম্বার। হিটলারের দর্শন, ভয় (হরর) তবু ভাল। কেননা, তারও শেষ আছে। অন্তহীন ভয়ের চেয়ে সে ভয় থেকে মুক্ত হতে কিছু দিনের জন্য ভয়কে সহ্য করা ভাল।
পাঠক বেশি ব্যাখ্যায় যাবেন না। আজকের দিনের রাজনীতির সঙ্গে অরওয়েলের ব্যাখ্যার কোনও সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন? নোটস্থগিত? সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, জিএসটি? কষ্ট করুন এক নতুন ভব্য ভারত গঠনের জন্য।
হিটলারের কথা বলতে গিয়ে স্তালিনের কথাও মনে করেছেন অরওয়েল। বলেছেন, স্তালিনের সমাজতন্ত্রেও এ রকম এক সামরিক সমাজতন্ত্র দেখা যায়। আসুন, এ বার আমরা স্তালিনকে নিয়ে আর এক বিশ্বখ্যাত দার্শনিক ও লেখক বার্ট্রান্ড রাসেলের একটি রচনার কথা শোনাই।
১৯৫৪ সালে রাসেল ‘নাইটমেয়ার্স অব এমিনেন্ট পারসন্স’ নামে একটি বই লেখেন। এই বইতে পৃথিবী বিখ্যাত কিছু ব্যক্তির কল্পিত দুঃস্বপ্ন লিপিবদ্ধ করা হয়। এই বইয়ের একটি অধ্যায় স্তালিনের দুঃস্বপ্ন। স্তালিনের মৃত্যু হয় ১৯৫৩ সালে। এই লেখাটি রাসেল লিখেছেন তাঁর মৃত্যুর এক বছর পর। মানে, স্তালিন এই লেখাটি পড়ার সুযোগ পাননি।
কল্পিত পটভূমি হল এ রকম। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। স্তালিন এ বার হেরে গেছেন। পশ্চিমে মিত্রশক্তির হাতে স্তালিন এখন বন্দি। আসলে লাল মরিচ মেশানো এক গ্লাস ভদকা গলায় ঢেলে স্তালিন তাঁর চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমোতে ঘুমোতে তিনি দুঃস্বপ্নটি দেখেন। তাতে দেখা যায়, এক ছোট্ট গ্রামের একটি ঘরে তিনি বন্দি। সারাক্ষণ দরজা-জানলা বন্ধ। সারা দিনে এক বার দরজা খুলে তাঁকে খোলা হাওয়ায় হাঁটিয়ে আনা হয়। পড়ার জন্য বাইবেল দেওয়া হয়। আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে স্তালিনের মনের পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে।
স্তালিন রাগে ফেটে পড়ে বলেছিলেন, ভদ্রমহোদয়গণ, জীবনের আনন্দের আপনারা কতটুকু জানেন? একটা গোটা জাতিকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখার মধ্যে কী মাদকতাময় সুখের অনুভূতি আছে, সেটা কি বোঝার ক্ষমতা আছে আপনাদের? যখন বুঝতে পারছেন, সবাই আপনাকে ঘৃণা করছে, অথচ প্রকাশ্যে সে কথা বলার লেশমাত্র সাহস পাচ্ছে না কেউ, সেটার এক নিবিড় আনন্দ। শুধু শত্রু নয়, ক্ষমতা রক্ষার জন্য বন্ধুকেও বিনাশ করার প্রয়োজন। স্তালিনের এই কথোপকথনের রচয়িতা রাসেল। এর মধ্যে ছিল রাজনৈতিক শ্লেষ।
এ সবই হল স্বৈরতন্ত্রের ব্যাকরণ। আজকের ‘পোস্ট ট্রুথ’ যুগে স্বৈরতন্ত্র আসছে গণতন্ত্রের বজ্রনির্ঘোষে। হিটলারের মহিমা কীর্তনে একটি তথ্যচিত্র প্রচারিত হয় সরকারি ভাবে। অনেক ফিল্মবোদ্ধা বন্ধু আমাকে বলেছেন, ‘প্রোপাগান্ডা’ কী ভাবে করতে হয় তা শেখার জন্য এই ছবিটি দেখা প্রয়োজন। আর এখন তো চার দিকে লাখ-লাখ কোটি কোটি গোয়েবল্স জন্ম নিয়েছে। একে বলা হচ্ছে ‘দ্য রাইজ অব দ্য মিসইনফর্মেশন ইন্ডাস্ট্রি’। গোটা পৃথিবী জুড়েই এখন এই ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর জয়জয়কার।