সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।’ না, মুখ্যমন্ত্রীদের সহিত টেলিকনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর মুখে গীতার শ্লোকখানি উদ্ধৃত হয় নাই। হইতেই পারিত। বৈঠকে উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রীদের তিনি বলিয়াছেন, অর্থনীতি লইয়া দুশ্চিন্তা করিতে হইবে না— তাহার স্বাস্থ্য অটুট আছে। দুনিয়াব্যাপী উথালপাথালের মধ্যেও ভারতীয় অর্থব্যবস্থা কোন মন্ত্রে স্বাস্থ্যরক্ষা করিতে সমর্থ হইল, প্রধানমন্ত্রী বলেন নাই, কিন্তু বুঝ লোক যে জান সন্ধান। এবং, কেন অর্থনীতির স্বাস্থ্য লইয়া দুশ্চিন্তা করিতে হইবে না, তাহার কারণও সেই না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে লুক্কায়িত— অর্থনীতির রাশ তাঁহার হাতে বলিয়া। কুরুক্ষেত্রে পুরুষোত্তম পার্থসারথি ভিন্ন এহেন আত্মবিশ্বাসের উদাহরণ দুর্লভ। এক্ষণে একটিমাত্র সমস্যা— সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার রথে সওয়ার হন নাই। ফলে, তাঁহাদের উদ্বেগ হওয়া স্বাভাবিক। এমনকি, তাঁহার শরণাগতরাও উদ্বিগ্ন— যেমন, নীতীশ কুমার বিচলিত, কেন্দ্র সাহায্য না করিলে অভিবাসী শ্রমিকদের ঘরে ফিরাইবার ব্যবস্থা করা দুষ্কর। শুষ্ক আশ্বাসে সেই সমস্যা মিটিবার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
গত কয়েক বৎসরে নরেন্দ্র মোদী বহু বার ‘অ্যানিম্যাল স্পিরিট’, ‘ফান্ডামেন্টালস অব দি ইকনমি’ ইত্যাদি কথা আওড়াইয়াছেন। দেশে কর্মসংস্থানের হার কমিয়াছে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সঙ্কুচিত হইয়াছে, শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের হার নিম্নগামী হইয়াছে, বাজারে চাহিদা তলানিতে আসিয়া ঠেকিয়াছে— এবং, প্রধানমন্ত্রী বা তাঁহার পারিষদবর্গ জানাইয়াছেন, ভয় পাইবার কারণ নাই, অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত। কাজেই, প্রধানমন্ত্রীর মুখে ভয় না পাইবার আশ্বাস শুনিলে সুকুমার রায়ের ছড়া মনে পড়া বিচিত্র নহে। উপরন্তু, সেই পরিস্থিতির সহিত বর্তমানের ফারাক অলঙ্ঘ্য— কোভিড-১৯ অতিমারি অর্থনীতির যাবতীয় হিসাবকে গুলাইয়া দিয়াছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত বা স্বনিযুক্ত মানুষের সিংহভাগের আয় বন্ধ, ফলে ক্রয়ক্ষমতা নাই। অতএব, বাজারে চাহিদা এখন তলানিতে, এবং ভবিষ্যতেও তাহা বাড়িবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। শিল্পক্ষেত্রে উৎপদান বন্ধ। লকডাউন উঠিলেও তাহা পূর্ববৎ হইতে দীর্ঘ সময় লাগিবে— বাজার সম্বন্ধে বিনিয়োগকারীর আশঙ্কা তাহার একটি কারণ; অদক্ষ শ্রমিক না পাইবার সম্ভাবনা তাহার অন্য কারণ। কৃষি উৎপাদন এখনও অব্যাহত বটে, কিন্তু পণ্য পরিবহণে ধাক্কা লাগায় কৃষকের আয়ও অনিশ্চিত হইবার আশঙ্কা। এই সমস্যাগুলির কোনটিকে প্রধানমন্ত্রী কী ভাবে সামলাইবেন, এখনও জানা যায় নাই। অতএব, তাঁহার শরণ লইলেই পরিত্রাণ, এই আশ্বাসবাণীটি মুখ্যমন্ত্রীদের নিকট অবিশ্বাস্য ঠেকিতেই পারে।
রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি মুখ্যমন্ত্রীদের শিরঃপীড়া—মানুষ অভুক্ত, চিকিৎসার অভাবে পীড়িত, বেকারত্বে ধ্বস্ত— প্রতিটি সমস্যাই প্রাথমিক ভাবে মুখ্যমন্ত্রীদের। তাহার জন্য কেন্দ্রীয় সাহায্যের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিবার বিলাসিতা তাঁহাদের নাই। আর, যদি বা কেন্দ্র এই সব সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব লইত, তবুও কি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির উদ্বেগ গুরুত্বের দাবিদার নহে? প্রধানমন্ত্রী হয়তো বলিবেন, তিনি কথাটি আক্ষরিক অর্থে বলেন নাই, আশ্বস্ত করিতে চাহিয়াছেন মাত্র। প্রকৃত গলদটি আছে এই আশ্বাসের ভঙ্গিতেই। আর কাহারও ভাবিবার প্রয়োজন নাই, আমরাই সব পারিব— এই মানসিকতাই এই জমানার অভিজ্ঞান। এবং, নোটবাতিল হইতে জিএসটি, সব বিপদই এই একই মানসিকতার ফসল। বারংবার বিপর্যয়েও দম্ভ যায় নাই। তবে এই বারের প্রবল করোনা বিপর্যয়ের মুখেও যদি এই মানসিকতা বর্জিত না হয়, অঙ্গরাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের এবং রাজনৈতিক মতনির্বিশেষে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগকে মান্যতা দেওয়া না হয়, তবে বিপদ চরম। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে পার্থসারথি ভাবিলে মহাভারত অশুদ্ধ হউক বা না হউক, দেশের বিপদ বাড়িবে।