বর্ধমান বইমেলায় খুদে পাঠকেরা। নিজস্ব চিত্র
প্রাচীন বাংলা সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বেশ কয়েক বার নেপাল গিয়েছিলেন। প্রায় এক দশক অনুসন্ধানের পরে, ১৯০৭ সালে তিনি নেপালের রাজ-দরবারের পুথিশালা থেকে আবিষ্কার করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’। ইতিহাস গবেষকেরা মনে করেন, বাংলায় তুর্কি আক্রমণের কিছু পরেই বৌদ্ধ সাধকেরা এই সব পুথি নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে গিয়েছিলেন নেপাল বা তিব্বতের মতো দেশে। এই নিয়ে যাওয়ার পথ সহজ ছিল না। অনেক বিপদ সামলে বৌদ্ধ সাধকদের এই কাজ করতে হয়েছিল। কারণ, পুথিগুলির প্রতি তাঁদের ভালবাসা। পুথিগুলির মধ্য দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার তীব্র ইচ্ছা। ছাপাখানা আবিষ্কারের পরে পুথির জায়গা নিয়েছে বই। উৎপল দত্তের ‘সূর্যশিকার’ নাটকে আমরা দেখেছি তাঁর বই সুরক্ষিত রয়েছে শুনে মৃত্যু-পথযাত্রী কলহনের মুখেও ফুটে ওঠে ‘অনির্বচনীয় আনন্দ’-এর আভাস। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আজকে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ লগ্নে ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পুস্তকপ্রেমী বাঙালির বইয়ের প্রতি ভালবাসা? উত্তরটা খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যাওয়া যাক অন্তত একটা দশক আগে।
তখনও হাতে হাতে স্মার্টফোন আসেনি। মানুষের অবসর সময়ের একটা বড় অংশ জুড়ে বসেনি টিভি সিরিয়াল। সেই সব দিনে ফুটপাতের পুরনো দোকান হোক বা শহরের নতুন বইয়ের দোকান— দেখা মিলত নানা বয়সের মানুষের। কেউ হন্যে হয়ে খুঁজছেন রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’, কেউ বা জেন অস্টেনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ কেউ বা গীতবিতান। জন্মদিন, বিয়ে, অন্নপ্রাশনের মতো নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে বই উপহার দেওয়া হত। আর কাছের মানুষ, প্রিয় মানুষটিকে কিছু দেওয়ার কথা উঠলেও বইয়ের কথা ভাবতেন অনেকে।
বই তো কেবল উপহারমাত্র ছিল না। এক জনের চিন্তা ভাবনাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল বই। বইয়ের হাত ধরেই কত প্রেম দানা বেঁধে উঠত। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ বা সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ উপন্যাসের মতো একে অন্যকে বই উপহার দিতে গিয়ে কখন নিজের অজান্তেই ঘটে যেত মনের বিনিময়ও। বইয়ের হাত ধরেই কত অনিমেষ খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের মাধবীলতাকে। অমিত রায়রা খুঁজে পেয়েছেন লাবণ্যদের। আবার উল্টোটিও সত্য। একটি বই পাল্টে দিতে পারে মানুষের মনোজগৎ, চেতনাপ্রবাহ। ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, ‘‘পঠন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করে।’’ বইয়ের মধ্যে দিয়ে পাঠকের অন্তর্জগত তৈরি হয়। বইয়ের হাত ধরে বদলে যায় মানুষের জীবন, সমাজদর্শন। এ প্রসঙ্গে একটি ছেলের কথা মনে পড়ে। ছাত্রজীবনে সেই ছেলেটির হাতে এসে পড়ে বিবেকানন্দের রচনাসমগ্র। পরে সেই রচনাই ছোট ছেলেটিকে সুভাষচন্দ্র নামের মহীরুহ করে তুলেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় এক ট্রেন যাত্রার সময়ে পড়া লিও টলস্টয়ের ‘দ্য কিংডম অব গড উইদিন ইউ’ বইটি আমূল বদলে দিয়েছিল মহাত্মা গাঁধীর চিন্তাভাবনা।
এখন বই পড়ার অভ্যেস, চল চলে গিয়েছে এমনটা মোটেই বলা যাবে না। তবে একটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, উপহার হিসেবে বইয়ের দেওয়া, নেওয়া আগের থেকে অনেকটাই কমেছে। আজকের দিনে উপহার হিসেবে জামাকাপড়, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, ঘর সাজানোর জন্য নানা সামগ্রির চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভালবাসার চিহ্ন রূপে বই-এর বদলে নানা বিনোদন সামগ্রী উপহারই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। বইপ্রেমীদের কাছে এটা মোটেই সুখের খবর নয়।
ছাপা বইয়ের কৌলিন্য কমে যাওয়ার একটা কারণ বোধহয় ই-বুক আর অনলাইনে পড়ার অভ্যাস বাড়া। এখন জেলার নানা গ্রন্থাগারে পাঠকের সংখ্যা দিনে দিনে কমে চলেছে। এখন পাঠক ছাপা বই পড়ার বদলে ইন্টারনেটে পড়া বা ই-বুক পড়তেই বেশি স্বচ্ছন্দ। ইন্টারনেটের দৌলতে অনেক কালজয়ী বই সহজলভ্য হয়েছে। বাংলা তো বটেই, বিশ্বের অন্য সাহিত্যের বহু সৃষ্টিই আজ ইন্টারনেটের সৌজন্যে ঘরে বসে পড়ে নেওয়া যায়। আমরা কম্পিউটারের সামনে বসেই পড়ে নিতে পারি পাবলো নেরুদা বা আলবেয়ার কাম্যুকে। দিনে দিনে অনুবাদও ইন্টারনেটে সহজলভ্য হয়ে উঠছে। ফলে অন্যকে বই উপহার দেওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে বইয়ের গুরুত্ব ক্রমশ কমছে। কিন্তু তার পরেও, কোথাও যেন কিছু একটা বাকি থেকে যাচ্ছে। গুলজারের ‘বুকস’ কবিতায় (‘কিতাব’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদ) তাই হয়তো কবি লেখেন ‘অব কোর্স, দি ওয়ার্ল্ড অব নলেজ স্টিল লিভস অন/ বাট হোয়াট অফ/ দ্য প্রেসড ফ্লাওয়ার অব সেন্টেড মিসিভ্স/ হিডেন বিটুইন দেয়ার পেজেস/...দ্যাট পারহ্যাভস স্যাল নো লংগার বি’ (‘সিলেক্টেড পোয়েমস গুলজার’, অনুবাদ পবনকুমার বর্মা)।
তাই এত কিছুর পরেও ছাপা বইয়ের একটি আলাদা মাধুর্য রয়ে গিয়েছে। সদ্য আমরা ভ্যালেন্টাইন্স ডে পেরিয়ে এলাম। উপহার হিসেবে এ বার আমরা কি বই বেছে নিতে পারলাম না? দু’টি হৃদয়ের কাছাকাছি আসায় এখনও কি বই সেতু হয়ে উঠতে পারে না?
লেখক দুর্গাপুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের কর্মী