‘অনাগরিক’দের নির্বাসন?

এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্তির মানদণ্ড বড়ই এলোমেলো। ১৯৫১-র এনআরসি-র ওপর নির্ভর করা যায় না। তার ভিত্তি ছিল ১৯৫১-র ভারতীয় জনগণনা, যেখানে গ্রাম প্রশাসনের থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন অদক্ষ গণনাকারীরা।

Advertisement

অরিজিৎ সেন ও লিয়া ভার্গিজ়

শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:১৭
Share:

গতকাল বন্দি শিবিরের অভিজ্ঞতা কেমন, তার একটু আভাস দেওয়া গিয়েছে (‘‘মেয়েরা কাঁদত, খিদে পেত’’, আবাপ, ২৩-১২)। এ বার বলি, ১৯৮৫ থেকে ২০১৯ সালের মার্চ অবধি ১,১৭,১৬৪ জনকে বিদেশি ঘোষণা করেছে অসম। ২০১৬ সালে ৬৪টি নতুন ট্রাইবুনাল তৈরি হওয়ার পর ৩৬,৯৭০ জনকে বিদেশি ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ, জানুয়ারি ২০১৭ থেকে মার্চ ২০১৯-এর মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে বিদেশি চিহ্নিত হয়েছেন ১৩৭০ জন। এই সংখ্যার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ সংবাদমাধ্যমের তথ্যও— প্রচুর মানুষকে অবৈধ বিদেশি আখ্যা দেওয়ার জন্য বিদেশি ট্রাইবুনালগুলোর ওপর চাপ দিচ্ছে অসম সরকার। ২০১৭ সালে ‘গত দু’বছরে অক্ষমতা’র কারণে উনিশ জন অপসারিত ট্রাইবুনাল সদস্য যখন গুয়াহাটি হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তখনই এই তথ্য সামনে আসে। ট্রাইবুনাল সদস্যদের কর্মক্ষমতা কী পদ্ধতিতে বিচার করা হয়েছে, তা দেখতে গিয়ে অসঙ্গতি খুঁজে পায় আদালত। বিদেশি ট্রাইবুনাল আধা-বিচারবিভাগীয় সংস্থা ও তার সদস্যদের নিয়োগকর্তা হাইকোর্ট করা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দফতর তাদের উপর খবরদারি করে। অনুমান, চাপ এসেছিল সেই সূত্রেই।

Advertisement

এনআরসি-তে অন্তর্ভুক্তির মানদণ্ড বড়ই এলোমেলো। ১৯৫১-র এনআরসি-র ওপর নির্ভর করা যায় না। তার ভিত্তি ছিল ১৯৫১-র ভারতীয় জনগণনা, যেখানে গ্রাম প্রশাসনের থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন অদক্ষ গণনাকারীরা। গৃহস্থালির ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছিল, যার ফলে ভুল ব্যাখ্যা, এমনকি পরিবারের কোনও সদস্যের বাদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। রাজ্যের দূরতম প্রান্তেও পৌঁছননি গণনাকারীরা। উদাহরণ, চর এলাকা। এনআরসি যে হেতু প্রকাশ্য দলিল নয়, তাই কারও নাম আছে কি না, সেটা তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয়, ভুল সংশোধনও অসম্ভব। ওই তালিকা থেকে বাদ পড়া লোকেরা ব্যাপারটাকে গুরুত্বও দেননি। আসলে, তাঁদের ও তাঁদের বংশধরদের যে এই দশা হতে পারে, ভাবেননি। ১৯৭০ সালের রায়ে গুয়াহাটি হাইকোর্টও ‘সমসাময়িক পঞ্জি’ এনআরসি-কে নাগরিকত্বের প্রমাণ বলা যায় না বলেই জানিয়েছিল।

মুশকিল হল, ১৯৭১-কে সময়সীমা ধরে ২০১৯ সালে ভারতীয় ও বিদেশিদের আলাদা করার উপায় নেই। বাকি দেশের ক্ষেত্রে ৩০ জুন ১৯৮৭-র আগে জন্ম নেওয়া সবা‌ই ভারতীয়। কিন্তু অসম চুক্তির বলে নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারা অনুসারে ওই রাজ্যের জন্য বিশেষ কয়েকটি আইন তৈরি হয়েছিল। তা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জও করা হয়েছিল— আজও চূড়ান্ত রায় বেরোয়নি। আসলে, দু’দশক আগেও পরিচয়পত্র জিনিসটা ভারতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল না। বেশির ভাগেরই পাসপোর্ট নেই, জন্ম নথিভুক্ত করানো নেই, এমনকি সবাই নথিভুক্ত ভোটারও নন। এই অবস্থায় কেউ শুধু তাঁর নিজের নয়, বাবা-ঠাকুর্দার পরিচয়পত্র দেখাতে পারবেন, এটা আশা করা অন্যায়। ভয়ের কথা, ১৯৫১ বা ১৯৭১-এর পরিচয়পত্রের ওপর ভিত্তি করে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে বলা যে একটা আজব উপায়, তা জানার পরেও সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এবং যাঁদের নাম নেই তাঁদের কী হবে তা-ও বলা হয়নি।

Advertisement

যদি ধরেও নেওয়া হয় যে বিদেশি খোঁজার একটা ঠিকঠাক উপায় পাওয়া যাবে, তা হলেও সেই বিদেশিদের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট হয় না। ১৯৮৫ থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন অবধি মাত্র ২৯,৮৫৫ জন বিদেশিকে অসম থেকে ‘বহিষ্কার’ করা হয়েছে। অনেককে বাংলাদেশি অভিযোগে ফেরত পাঠানো হয়েছে— ‘পুশ ব্যাক’। বাংলাদেশ জানিয়েছে, এর বদলে ‘ডিপোর্টেশন’ বা নির্বাসন চলতে পারে। সেটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া— নির্বাসনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পাঠাবে রাজ্য, তা বিদেশ মন্ত্রকে যাবে, তারা বিষয়টা বাংলাদেশকে জানাবে, যারা আবার তদন্ত করবে। বাংলাদেশ যদি কাউকে চিহ্নিত করে, তবেই নির্বাসন দেওয়া যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কিরেন রিজিজু লোকসভায় জানিয়েছিলেন, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মাত্র ৩৯ জন বাংলাদেশি নাগরিককে বন্দিশিবির থেকে নির্বাসিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জানিয়েছে, এনআরসি-র ফলে হওয়া কোনও নির্বাসন তারা মানবে না।

এনআরসি-র সমর্থকেরা মনে করেন, এই পদ্ধতিতে শুদ্ধ অসমিয়া সত্তা রক্ষা করা সম্ভব। যে সমাজে পরিচয়পত্রের বাঁধন অতিসাম্প্রতিক, যেখানে একসঙ্গে বাস করা এবং অভিবাসনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সেখানে বিদেশির খোঁজ অসার। তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া আর কিছুই সিদ্ধ করে না। বাদ পড়া লোকেদের কলুষিত করা এবং তাঁদের প্রতি অমানবিক আচরণ ছাড়াও সমাজে এক গভীর বিভাজন তৈরি করছে এনআরসি। অন্য সংস্কৃতির শরণার্থী বা অভিবাসীকে বহিরাগত বলে দাগিয়ে দেওয়া পৃথিবী জুড়েই দেখা যায়। ভিয়েতনামিজ়-মার্কিন লেখক ভিয়েত থান গুয়েন-এর কথায়, “শরণার্থীদের— বাকিদের মতোই— সর্বত্র দেখতে পাওয়ার আগে তারা অচেনাই ছিল। মনে ভয় ছিল, তারা আমাদের সীমান্ত পার হবে, সংস্কৃতির দখল নেবে, মহিলাদের ধর্ষণ করবে, শিশুদের হুমকি দেবে, অর্থনীতি ধ্বংস করবে।”

দুর্ভাগ্য, এনআরসি-র ছাঁকনির ভেতর দিয়ে তাদের পার করা এবং অবৈধ বিদেশি ঘোষণা করে বন্দিশিবিরে পাঠানোর প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে, যার শেষ দেখা যাচ্ছে না। কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার এটাই প্রথম এবং বিপজ্জনক ধাপ, যাকে ১৯৫৮ সালের এক বিতর্কিত রায়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আর্ল ওয়ারেন বলেছিলেন, “(নাগরিকত্ব) ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, কেননা তা অধিকার পাওয়ার অধিকার। এই অমূল্য সম্পদ সরিয়ে দিন, পড়ে থাকবেন এক রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি।” ২০১৯’এ বিচারপতি ওয়ারেনের কথাগুলো বড্ড সত্যি হয়ে বাজছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement