ছবি: সংগৃহীত।
জম্মু ও কাশ্মীরে স্বাভাবিকতা ফিরিয়াছে, এমন দাবি গত এক বৎসরে বহু বার শোনা গিয়াছে। বহু বার পাল্টা অভিযোগ উঠিয়াছে, কাশ্মীর উপত্যকায় যে পরিস্থিতি চলিতেছে, কল্পনার কোনও প্রসারণের দ্বারাই তাহাকে ‘স্বাভাবিক’ বলা চলে না। অতি সম্প্রতি বিনা নোটিসে উপত্যকার একটি প্রধান সংবাদপত্র দফতরে যখন সরকারি পেয়াদা আসিয়া তালা লাগাইয়া দিল, বুঝিতে বাকি রহিল না, এই সংবাদপত্রের সম্পাদিকা মোদী ও বিজেপি বিরুদ্ধতার এক প্রধান স্বর বলিয়া তাঁহার কাগজকে বন্ধ করা হইল। গণতান্ত্রিক ভারতের দস্তুর ঠিক এই রকম নহে, সুতরাং ইহাকে স্বাভাবিক বলিয়া মানিতে অসুবিধা হইবেই। উপরন্তু, কয়েক দিন আগে ‘পঞ্চায়েতি রাজ আইন, ১৯৮৯’ সংশোধন করিয়া জেলা উন্নয়ন পরিষদ গঠন করিবার কথা জানাইয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার, যাহার প্রতিনিধিরা জনতার ভোটে নির্বাচিত হইবেন। পূর্বে যখন এই প্রদেশ রাজ্যের মর্যাদা পাইত, তখন পর্ষদগুলি পরিচালনা করিতেন মন্ত্রিসভার কোনও সদস্য বা বিধায়ক বা সাংসদ। জেলা স্তরে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন রূপায়ণের কাজটি পর্ষদের মাধ্যমেই হইত, যাহার মূল অর্থ রাজ্য বাজেট হইতে আসিত। কেন্দ্রের বক্তব্য, স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে পোক্ত করিবার লক্ষ্যেই সরকারের তৃতীয় স্তরে (অর্থাৎ স্থানীয় প্রশাসন) ক্ষমতায়নের এই বন্দোবস্ত। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু কেন্দ্রের সহিত স্থানীয় স্তরের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হইলে সরকারের দ্বিতীয় স্তরের (অর্থাৎ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকার) ক্ষমতা হ্রাস পাইবে, যাহা অপরাপর প্রাদেশিক সরকারের সহিত একরূপ নহে। অর্থাৎ, ইহা স্বাভাবিক নহে। অস্বাভাবিক বলিয়াই অনুমান করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার কোনও সম্ভাবনা রহিল না।
সরকারের অন্যতম স্তরটি হীনবল হইবার ঘটনা প্রশাসন অপেক্ষা রাজনীতির নিকট অধিক অর্থবহ। পিডিপি-র নইম আখতার তাহাকে ‘রাজনীতির অবসান’ বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন। রাজনীতির পরিসর সাধারণ মানুষকে মত প্রকাশের সুযোগ দেয়। তাহাকে শতধা দমিত করিলে জনতাও বিভ্রান্ত হয়। প্রদেশের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন রূপায়ণের খুঁটিনাটিতে বিধানসভার সদস্যদের ভূমিকা খর্ব করিবার নীতিতে সেই অবদমনের প্রবণতা স্পষ্ট। তদুপরি, ক্ষমতার মধ্যবর্তী স্তরটিকে এমন ভাবে মুছিয়া ফেলিলে ক্রমশ প্রশাসনিক কার্য নির্বাহে আমলাতন্ত্র এবং নিরাপত্তা বাহিনীর শরণ লওয়া ব্যতীত উপায় থাকিবে না। কেন্দ্র অবশ্য দাবি করিতেছে, নেতৃবৃন্দ মুক্তি পাইবার পর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সূচনার নিমিত্ত স্থানীয় স্তরে কাঠামো নির্মাণ অপরিহার্য ছিল। যদিও নূতন নীতিতে জেলা পরিষদগুলি ক্ষমতা অর্জন করিলে প্রকারান্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণই শক্তিশালী হইবে; তাহাদের হস্তেই থাকিবে ক্ষমতার চাবিকাঠি। কাশ্মীরে অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা মুক্তিলাভ করিয়াছেন, পর্যটকদের ফের আহ্বান জানাইতেছে প্রশাসন। পঞ্চায়েত স্তরে নির্বাচনের আয়োজনও ইহার সহিত সুসঙ্গত। কিন্তু স্মরণে রাখিতে হইবে, সকল রকমের বিরোধী রাজনৈতিক স্বরকে অবদমিত করিয়া যে অগণতন্ত্র সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হইতেছে— আর যাহাই হউক, তাহা ‘স্বাভাবিক’ নহে।