দিল্লির সীমানায় আন্দোলনকারী কৃষকেরা। ছবি: পিটিআই।
নরেন্দ্র মোদী বিক্ষুব্ধ কৃষকদের নিকট আবেদন জানাইয়াছেন, তাঁহারা কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছায় বিশ্বাস রাখুন। আবেদনটিকে নির্বিষ বলা চলিবে না, তাহার মধ্যে বিরোধীদের প্রতি উদ্দিষ্ট একটি হুলও আছে। তাঁহার বাণী: কৃষকরা অতীতে (কংগ্রেস জমানায়) বার বার ঠকিয়াছেন, তাই সরকারের কথায় ভরসা রাখা তাঁহাদের পক্ষে কঠিন, কিন্তু এই বার (বিজেপির রামরাজ্যে) সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হইবে না, নয়া কৃষি আইনে তাঁহাদের মঙ্গলই হইবে। স্পষ্টতই, দেশের প্রধানমন্ত্রী কৃষক আন্দোলনকে উপলক্ষ করিয়া ‘আমরা বনাম ওরা’ মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়িবার স্থূল রাজনীতি হইতে আপনাকে বিরত রাখিতে পারেন নাই। বোধ করি চাহেনও নাই। ঢেঁকি বারাণসীতে গিয়াও ধান ভাঙে। এমন আকুল আবেদনে চিঁড়া ভিজিবে কি না, মহাবলী প্রধানমন্ত্রীও অবশ্য সেই প্রশ্নের উত্তর জানেন না। তবে তিনি এবং তাঁহার পারিষদরা বিলক্ষণ জানেন, তাঁহারা আপাতত স্বখাত সলিলে। কমিটি বসাইয়া অবস্থা সামাল দিবার প্রাচীন কৌশলটিও, অন্তত প্রথম দফায়, কাজ করিল না। সমস্ত প্রতিবাদ আন্দোলনকে ছলে বলে কৌশলে দমন করিয়া রাজ্যপাট চালাইবার যে রীতিতে তাঁহারা অভ্যস্ত, সংগঠিত কৃষকদের প্রবল প্রতিস্পর্ধার সম্মুখে এখনও পর্যন্ত তাহা কেবল পর্যুদস্ত নহে, দিশাহারা। বিক্ষোভ ঠান্ডা করিবার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্র সম্ভবত উত্তর ভারতের শৈত্যপ্রবাহের ভরসায় অপেক্ষমাণ।
যে দাবিতে পঞ্জাব হরিয়ানার মতো অঞ্চলগুলির কৃষকদের এই বিক্ষোভ, তাহাকে অযথা মহিমান্বিত করিবার কোনও সুযুক্তি নাই, ইহা গোষ্ঠীস্বার্থের দাবি। নূতন কৃষি নীতির ফলে এপিএমসি নামক বিশেষ ব্যবস্থাকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করিয়া খোলা বাজারে কৃষিপণ্যের বিপণন চালু করিবার নববিধানটি বলবৎ হইলে এক দিকে অতিকায় মান্ডিগুলির মাধ্যমে চাল-গমের মতো গুরুত্বপূর্ণ শস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের স্থিতাবস্থা ভাঙিয়া যাইবে, অন্য দিকে এই ধরনের শস্যের জন্য সরকারি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) রক্ষাকবচটিও ক্রমে বিসর্জন দেওয়া হইবে— এই আশঙ্কাতেই প্রধানত উত্তর-পশ্চিম ভারতের সম্পন্ন কৃষক তথা কৃষিপণ্যের কারবারিরা শঙ্কিত। তাঁহারা মুক্ত বাজার চাহেন না, কারণ নিয়ন্ত্রিত বাজারের চাবিকাঠি তাঁহাদের করায়ত্ত। ভারতীয় কৃষি যে উদার আর্থিক নীতির সুযোগ হইতে বহুলাংশে বঞ্চিত, তাহার একটি বড় কারণ এই ক্ষমতাশালী স্বার্থগোষ্ঠীর ধারাবাহিক বিরোধিতা। যত বার কৃষি নীতির সংস্কারের উদ্যোগ হইয়াছে, তত বারই তাঁহারা প্রবল ভাবে বাধা দিয়াছেন এবং সরকার পিছু হটিয়াছে, অনেক সময় উদ্যোগপর্বেই থামিয়া গিয়াছে।
এই ইতিহাস জানেন বলিয়াই বোধ করি প্রধানমন্ত্রী মোদী অতিমারি পরিস্থিতির সুযোগে সংসদে যেন তেন প্রকারেণ কৃষি বিল পাশ করাইয়া লইয়াছিলেন। এখন যাহা ঘটিতেছে, তাহা সেই জবরদস্তির প্রতিক্রিয়া। গণতান্ত্রিক রাজনীতির আলাপ-আলোচনা ও তর্কবিতর্কের দাবিকে ন্যায্যমূল্য চুকাইয়া না দিলে ধূমায়িত প্রতিবাদ বিক্ষোভ রাস্তার রাজনীতিতে ফাটিয়া পড়ে, আগে অথবা পরে। মোদী সরকার ও বিভিন্ন রাজ্যের (প্রধানত) বিজেপি সরকারগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই দাবি যথেচ্ছ ভাবে লঙ্ঘন করিয়া আসিতেছে। তাহার প্রতিক্রিয়া ইতিপূর্বেও দেখা গিয়াছে, যেমন প্রায় তিন বছর আগে কৃষকদের ‘লং মার্চ’-এ, কিংবা এক বছর আগে দিল্লির শাহিনবাগে। এখন সেই প্রক্রিয়াতেই কৃষকরা ঘোষণা করিতেছেন: দিল্লি চলো। এখানেই এই আন্দোলনের প্রকৃত তাৎপর্য। একটি স্বার্থগোষ্ঠীর নিজস্ব প্রতিবাদ এই ভাবেই রাষ্ট্রীয় দমন নীতির বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধার প্রতীক— এবং হয়তো বা বৃহত্তর প্রতিস্পর্ধার অনুঘটক— হইয়া উঠিতে পারে, এই মুহূর্তের উত্তর ভারতে তাহার নূতন ইতিহাস রচিত হইতেছে। নরেন্দ্র মোদীর গঙ্গাজলে ইহার গভীর তাৎপর্য মুছিবে না।