পরীক্ষা: মুসলিমবিরোধী আক্রমণে নিহতকে ঘিরে শোকাকুল পরিজন, দিল্লি, ২৭ ফেব্রুয়ারি। রয়টার্স
অমিত শাহ কলকাতায় এসে দিল্লির সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কথা বলেননি বলে অনেকে অবাক হয়েছেন। কারণটা বোঝা গেল না। বরং এতই প্রত্যাশিত তাঁর আগমন ও বক্তব্য প্রক্ষেপণ যে, এত বড় মাপের নেতা কী করে এতখানি ‘প্রেডিক্টেবল’ হন, সেটা ভেবেই অবাক লাগার কথা। দিল্লি নিয়ে কিছু তাঁর বলার ছিল না, বলা স্বাভাবিকও ছিল না। যা যা তাঁর বলার ছিল, ঠিক ঠিক বলে গিয়েছেন তিনি। বলে গিয়েছেন, তিনি ও তাঁরা সোনার বাংলা গড়বেন। বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ‘অনুপ্রবেশকারী’দের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন, ‘উদ্বাস্তু’দের কথা ভাবেন না। বলেছেন, নরেন্দ্র মোদী যখন সিএএ পাশ করান, মমতাদিদি তখন দাঙ্গা লাগান এ রাজ্যে। এ সবই তাঁর বলার কথা ছিল, এই সময়েই। তাতে সাড়াও এমনই হওয়ার কথা ছিল, ‘গোলি মারো’ ধরনের। বরং সাড়াটা আরও একটু উচ্চগ্রামে হতে পারত। হয়নি।
দিল্লির আগুন এখনও নেবেনি, রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি। ‘দাঙ্গা’ নয়, মুসলিমনিধন যজ্ঞ চলেছে সেখানে। সেই ভয়ানক যজ্ঞের কোনও দায়িত্ব না নিয়ে উল্টে ‘পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা চলছে’ বলার লক্ষ্য ছিল একটাই। চার দিকের ধিকিধিকি আঁচে যৎপরোনাস্তি ইন্ধন দিয়ে যাওয়া। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন— যাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনি কথা বলেন, তাঁরা কোনও প্রশ্ন তোলেন না। ‘সোনার বাংলা’ যে সিপিএম বা তৃণমূলের আমলে দেখা যায়নি, তা ঠিক। কিন্তু যে বিজেপির হাতে পড়ে গোটা দেশ ‘সোনার ভারত’ হওয়ার বদলে দিন দিন তলিয়েছে গভীর অতলে, অর্থনৈতিক সঙ্কটের কালো খাদ যখন কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-চাকরি সব কিছু গ্রাস করছে, সেই বিজেপি কী করে বাংলাকে পাল্টাবে, এমন সংশয় ভুলেও মনে স্থান দেন না তাঁরা। কোনও যুক্তি বা তথ্যপ্রমাণ চান না। যুক্তিকে টুঁটি টিপে মেরে, তথ্যপ্রমাণ বস্তুটাই উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী তাঁরা।
পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের রাজ্য, তাই ও পার থেকে মানুষ সমানেই এসে পৌঁছন এ দিকে। এ এক বড় সমস্যা। বহু ধরনের মুশকিলে পড়েই তাঁরা আসেন এ দেশে, কিন্তু সে সব তো মানবিক বিবেচনার কথা। ঘটনা হল, অমিত শাহের সমর্থকেরা আর একটা বিবেচনা ভুল করেও করেন না। বুঝতে চান না যে, সিএএ আসলে বাড়তি মানুষের চাপ সামলানো নামক সমস্যার সমাধান নয়— উল্টে, এই নতুন প্রবেশকারীদের হিন্দু অংশটিকে এক কথায় নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়ার পথ। ‘অনুপ্রবেশকারী’ কথাটাকে যদি ‘মুসলিম’-এর প্রতিশব্দ না ভেবে আমরা তার সত্যিকারের অর্থে গ্রহণ করি, তা হলে বলতেই হয়, সিএএ হল অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্বে বরণ করার সহজতম পদ্ধতি। এবং, এই আইনে হিন্দুদের মুসলিম থেকে আলাদা করার বিষয়টা সরিয়ে রেখে যদি ভাবি, যদি মনে রাখি যে বাংলাদেশ থেকে যাঁরা চুপচাপ সীমান্ত পেরিয়ে আসেন, অমিত শাহদেরই মতে তাঁদের একটা বড় অংশ হিন্দু (কেননা ‘চূড়ান্ত সংখ্যালঘু নির্যাতন’ চলে ও দেশে)— তা হলে মোদী ও শাহ কিন্তু এই আইনে তাঁদের নাগরিকত্ব দিয়ে রাজ্যের জনসংখ্যা বাড়ানোর পথটাই পরিষ্কার করছেন।
অমিত শাহ ও তাঁদের সমর্থকেরা ঠিক যা করার, তা-ই করছেন, তা-ই করবেন। সুতরাং ওঁরা ওঁদের কাজ অনলস ভাবে করে যাবেন ধরে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বরং ভাবুক, বাকিরা কী করবেন এ বার।
দিল্লি থেকে কি কিছু বোঝার আছে এই রাজ্যের? আছে। বোঝার আছে যে, দিল্লিতে এই ঘটনা যে কারণে ঘটল, সেই একই কারণে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গেও এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা ষোলোর জায়গায় আঠারো আনা। দিল্লিতে বিজেপি নেতারা যে ‘রাস্তায় নামা’র আহ্বান জানালেন, তার কারণ গত কয়েক মাস ধরে দিল্লি কার্যত গোটা দেশকে অবাক করে রেখেছে। শাহিন বাগ আমাদের চমকে দিয়েছে। দাদি-দের আন্দোলন যে এই জায়গায় যেতে পারে, তা না দেখলে আমাদের দেশ বিশ্বাস করত কি? শুধু শাহিন বাগই তো নয়। জামিয়া বা জেএনইউ-ও কি প্রশাসনের রক্তচাপ বাড়িয়ে রাখেনি? জামিয়ার ছাত্রদের উপর উদ্দাম প্রহার, জেএনইউ-এ উন্মত্ত তাণ্ডব, জামিয়ার সামনে গুলিচালনা এবং শেষে উত্তর-পূর্ব দিল্লি ছারখার— প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশাসন ও পুলিশের ন্যক্কারজনক ভূমিকা বলে দেয় কতখানি কোণঠাসা বোধ করলে প্রতিবাদীদের এই ভাবে পীড়ন করার ‘সিদ্ধান্ত’ নেওয়া হয়।
প্রতিবাদের তীব্রতাই দিল্লির ভয়ানক ঘটনাবলির পূর্বশর্ত। অর্থাৎ দিল্লিতে ঘটেছে দু’টি সমান্তরাল ঘটনা। এক দিকে, বিছিয়ে গিয়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদের উর্বর জমি, যা ক্রমাগত হরিয়ানা আর উত্তরপ্রদেশ থেকে ইন্ধন পেয়ে থাকে। অন্য দিকে, নাগরিক অধিকারপন্থী ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী স্বর লাগাতার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। রক্ষণশীল ও লিবারাল দুই দিক থেকে দুই উচ্চচাপের সংঘর্ষেই ঘটেছে বিভীষিকাময় অগ্ন্যুৎপাত। এই কারণেই ২০২০’র দিল্লি ১৯৮৪’র দিল্লি থেকে বিস্তর আলাদা।
এবং ঠিক এই জায়গাটাতেই কলকাতা হয়তো পরবর্তী সম্ভাব্য ‘লক্ষ্য’। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এই দ্বিমেরু অবস্থানের জন্যই। এই সীমান্তবর্তী দেশভাগ-যন্ত্রণা-জর্জরিত রাজ্যটির মানুষের এক বড় অংশের মধ্যে কত গভীর মুসলিমবিদ্বেষ, এত দিনে তা পরিষ্কার। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গের জনসমাজের মধ্যে যে কত অগুনতি ‘যাদবপুর’ বা ‘পার্ক সার্কাস’ লুকিয়ে, তা-ও স্পষ্ট। নানা ধরনের প্রতিবাদ এখানে, হার না মানা কিংবা পিছু না হটার মানুষ অগণিত। এই রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী শক্তির শাসন থাকলে কী হবে, ইতিমধ্যেই নানা রাজনৈতিক দলে নেতানেত্রীরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা কখন প্রতিবাদ করবেন আর করবেন না, সে তাঁদের ‘মর্জি’, তাঁদের ‘হিসেব’। নাগরিক সমাজকে তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে চলবে না। নিজেদের জোরেই এগিয়ে চলতে হবে নাগরিকদের। লক্ষণীয়, সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ কিন্তু কলকাতাতেও এক দিনও বিশ্রাম নেয়নি। কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও, প্রদীপ জ্বেলে রেখেছেন। তাই, অমিত শাহেরা যখন ভোটযুদ্ধে সর্বশক্তিতে নামবেন, সম্ভবত বেছে নেবেন দিল্লির পথটাই। ‘রাস্তায় নেমে আইন হাতে তুলে নেওয়া’র পথ, কপিল মিশ্রের ভাষায়।
প্রায়-নিশ্চিত এই ভবিতব্যের জন্য অমিত শাহের পশ্চিমবঙ্গ যে প্রস্তুত, ‘গোলি মারো’ দলই তার প্রমাণ। আর অন্য পশ্চিমবঙ্গ? যথেষ্ট প্রস্তুত তো? গোলি মারো দলকে রাজ্য পুলিশ গ্রেফতার করায় তা থেকে দিল্লি পুলিশকে শিক্ষা নিতে বলা হচ্ছে আজ। এই দীপ্ত সাহস বজায় রাখবে তো রাজ্যের প্রশাসন? পুলিশবাহিনী প্রতি মুহূর্তে সতর্ক ও সক্রিয় না থাকলে যেখান-সেখান থেকে নৈরাজ্য ও প্রাণহানি শুরু হতে পারে, কিন্তু পুলিশ প্রস্তুত থাকলে তা আটকানো সম্ভব। জ্যোতি বসুর প্রশাসন দেখিয়ে দিয়েছিল বিরানব্বই সালে কী ভাবে কঠিন মোকাবিলায় সঙ্কট আটকানো যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন সেই শিক্ষায় শিক্ষিত, রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষায় সদাজাগ্রত— এমন আমরা ধরে নিতে পারি তো?
স্পষ্ট করে বলা ভাল, একটা বড় দায়িত্ব রাজ্যের মুসলিম সমাজেরও। সিএএ তথা সমগ্র বিজেপি রাজনীতিই তাঁদের প্রতি খড়্গহস্ত, তাই অত্যন্ত সতর্ক থাকা ছাড়া উপায় নেই কোনও। গত কয়েক মাস ধরে তাঁরা বুঝিয়েছেন, তাঁরা সতর্ক আছেন, নানা কু-প্রণোদনাতেও বাংলার মুসলিম সমাজের অধিকাংশই ভুল পদক্ষেপ করেননি, ঠিক পথে প্রতিবাদে স্থির থেকেছেন। ভুল পথে যাঁরা পা বাড়িয়েছেন, তাঁদের ফাঁদে পা দেননি। শত সঙ্কটেও এই বিবেচনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণবোধ রেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই আজ। সম্মেলক সামাজিক প্রতিবাদের থেকে এই কঠিন যুদ্ধের আর কোনও পথ নেই।
তবে, সবচেয়ে বড় দায়িত্বটা কিন্তু— অবশিষ্ট নাগরিক সমাজের। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম মানুষের উপর বড় ধরনের বিপদ নেমে আসছে, নতুন করে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তুতি চলছে, এটা মনে রেখে হিন্দু বাঙালি সমাজ কোমর বাঁধলে, শক্ত করে প্রতিবেশীর হাত ধরে থাকলে, সংযম ও নিয়ন্ত্রণের অভ্যাস করলে, নিজেদের বহু কালের সহিষ্ণু সংস্কৃতির উপর বিশ্বাস রাখলে, বিপদ পেরিয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব। বঙ্গভঙ্গও তো রদ হয়েছিল, ১৯১১ সালে? ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?’— এমন পঙ্ক্তিও তো লেখা হয়েছিল, সেই বিপদ কেটে যাওয়ার পর? সবচেয়ে বড় কথা, প্রশাসন যাতে প্রশাসনের কাজটা করে, তা নিশ্চিত করতে পারে নাগরিক সমাজই। এই অন্ধকার বিপদসঙ্কুল রাতে, তাকে তাই পাহারায় জেগে বসে থাকতে হবে।
জেগে থাকতে হবে একটি বিশ্বাস নিয়েই। মানুষ যে অমানুষ নয়, সেই বিশ্বাস। আমাদের সেটা আছে কি না, অমিত শাহেরা ওটাই পরীক্ষা করে দেখছেন। তা করতেই তিনি এসেছিলেন। করে গেলেন।