বিচারপতি মুরলীধর।
সম্পূর্ণ শহর ছাই হইলে তবে এফআইআর করা হইবে কি?— দিল্লি পুলিশের কাজকর্ম দেখিয়া প্রশ্ন তুলিয়াছেন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলীধর। বোধ করি স্বাভাবিক ভাবেই, তিনি আর দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি নাই, যে দিন প্রশ্ন তুলিয়াছেন সেই রাত্রিতেই তাঁহাকে পঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলি করিবার সিদ্ধান্ত পাকা হইয়াছে। সৌভাগ্য— স্থানান্তরিত হইবার আগে অত্যন্ত জরুরি প্রশ্নটি তুলিয়া দিয়া গিয়াছেন, অনেক ধোঁয়াশা কাটাইয়া দিয়াছেন। যে সব ভিডিয়ো এবং তথ্য তিনি ও তাঁহারা দেখিবার, জানিবার সুযোগ পাইয়াছেন, দেশের পরিব্যাপ্ত নাগরিক সমাজের অনেকেই তাহা পায় নাই। সুতরাং তাঁহাদের বিবেচনা নাগরিককেও সাহায্য করিতেছে পরিস্থিতি বুঝিতে। এখন আরও অনেক স্পষ্ট হইতেছে যে, এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকাকে শুধু বিচ্যুতি বলিয়া দেখা কঠিন, বস্তুত অসম্ভব। তিন দিন ব্যাপী এই অক্ষমণীয় নিষ্ক্রিয়তাকে ‘রাজধর্ম’ হইতে বিচ্যুতি বলা সম্ভবত কেবল হিমশৈলের চূড়াটিকে দেখা। ইহার পিছনে একটি বিশালাকার নিমজ্জিত ‘রাজনীতি’ আছে, তাহার কথা সরাসরি বলা জরুরি। রাজধানীতে নাগরিকেরা নিহত, আহত, অগ্নিদগ্ধ, নির্যাতিত হইয়াছেন পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায়, সহায়তা চাহিয়াও পান নাই, হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকিতে বাধা দেওয়া হইয়াছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরিয়া। মনে করিবার বিলক্ষণ কারণ আছে যে, এই ঘটনাগুলি সরকারি অকর্মণ্যতার প্রমাণ নহে, সরকারি রাজনীতিরই ইঙ্গিত। পুলিশ যদি ঘটনার মধ্যে দাঁড়াইয়া আক্রমণকারীকে না গ্রেফতার করিয়া নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে, ধরিয়া লইতে হইবে নির্দেশকদের মনোবাঞ্ছা জানিয়াই তাহা করা হইতেছিল। পশ্চিমবঙ্গের এক মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছিলেন, সরকার না চাহিলে কখনও দাঙ্গা বাধে না। তিন দিন ধরিয়া নারকীয় অভিজ্ঞতার শরিক উত্তর-পূর্ব দিল্লি এই কথার হাতে-নাতে প্রমাণ।
অবশেষে তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী টুইট করিয়াছেন। তাঁহার পক্ষে সম্ভবত ইহার অপেক্ষা বড় পদক্ষেপ ভাবাই যায় না। টুইটবার্তাটি বলিয়াছে, শান্তি ও সৌভ্রাত্র বজায় রাখা জরুরি। তাঁহার পক্ষে সম্ভবত ইহার অপেক্ষা বড় তিরস্কার কিছু হইতে পারে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক করিয়াছেন, তাঁহার অন্যান্য হাতের কাজ মিটাইয়া, দুই দিন পর। তাঁহার পক্ষে ইহার অধিক তৎপরতা সম্ভবত ভাবাই যায় না। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে তাঁহাকে যাইতে দেখা যায় নাই, সম্ভবত এমন কিছু ঘটে নাই যাহাতে সেখানে তাঁহার আবির্ভাবের প্রয়োজন হইতে পারে। সেখানে গিয়াছেন জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। সম্ভবত ইহা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার বিষয় নহে। ডোভাল বলিয়াছেন, যাহা হইয়াছে তাহা হইয়াছে। সম্ভবত এমন হাড়কাঁপানো হিংসার পর এই আধ্যাত্মিকতায় উপনীত হওয়াই জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টার কাজ। ডোভাল বলিয়াছেন, এখন হইতে নিরাপত্তা দিবার কাজ সরকার ও পুলিশের। প্রশ্ন উঠিতে পারিত যে ‘ইহার আগে’ কেন এই কাজ তাহাদের ছিল না। সম্ভবত সেই প্রশ্ন উঠাইবার দরকার নাই। উত্তরটি চোখের সম্মুখে জ্বলজ্বল করিতেছে: রাজনীতি।
দিল্লিতে এমন কিছু ঘটিতে পারে, এই সংবাদ সরকারের কাছে ছিল কি না, জানিতে চাহিয়াও লাভ নাই। যদি না থাকিয়া থাকে, তবে সরকার কিসের জন্য আছে, সেই প্রশ্ন উঠিবে। সমগ্র ঘটনাবলিতে শীর্ষনেতা ও মন্ত্রীদের ভূমিকা ঠিক কী ও কোথায়, তাহা ষোলো আনা না জানিলেও এই সিদ্ধান্ত অ-নিবার্য যে, তাঁহাদের নীরবতা, অসক্রিয়তা ও অসহযোগিতাই তাঁহাদের রাজনীতি। এই রাজনীতিতেই গণতান্ত্রিক ভারতের সর্বনাশ ঘনাইতেছে। কেবল সমাজের সর্বনাশ নহে, রাষ্ট্রেরও। যে রাষ্ট্র তাহার সমস্ত ন্যায়নীতি, উচিত-অনুচিতের বোধ সঙ্কীর্ণ অন্ধবিশ্বাসের রাজনীতিতে বিসর্জন দিয়াছে, ইহাই তাহার পরিণতি।