কালব্যাধি উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমস্ত অবয়ব জুড়িয়া ব্যাধির লক্ষণগুলি স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর হইতেছে। দিল্লি পুলিশ সেই অবয়বের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাহার কারণ, দিল্লি কেবল দেশের রাজধানী নহে, দিল্লি পুলিশ সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন। অমিত শাহের জমানায় এই বাহিনীটির কীর্তিকলাপ কোথায় পৌঁছাইয়াছে, কেবল রাজধানী নহে, গোটা দেশ তাহার সাক্ষী। সুতরাং, রাজনীতিক সীতারাম ইয়েচুরি বা যোগেন্দ্র যাদব হইতে শুরু করিয়া জয়তী ঘোষ, অপূর্বানন্দের মতো শিক্ষকের নাম দিল্লির হিংসাত্মক ঘটনাবলির চার্জশিটে উল্লেখ করিবার নূতন কীর্তিতে আজ আর কেহই বিস্মিত হন নাই। যে সব স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাঁহাদের নামোল্লেখ, সেগুলি যথার্থ স্বীকারোক্তি, না জোর করিয়া আদায় করা হইয়াছে— তাহা লইয়াও বড় রকমের সংশয় আছে। সংশয়ের গভীরে নিহিত রহিয়াছে মূল প্রশ্ন: দিল্লি হিংসা লইয়া ষড়যন্ত্রের তদন্ত হইতেছে, না সেই হিংসা এবং এই তদন্ত একই ষড়যন্ত্রের দুই প্রকরণ? যথার্থ তদন্তই যদি শাসকদের লক্ষ্য হয়, তবে সর্বশ্রী কপিল শর্মা প্রমুখেরা হাটের মাঝে দাঁড়াইয়া হিংসায় ইন্ধন জোগাইবার পরে আজও বুক ফুলাইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন কী করিয়া? স্বৈরাচারী মানসিকতার সহিত যদি অপদার্থতার মিশ্রণ ঘটে, তাহার প্রকাশ দ্বিগুণ কুৎসিত হইয়া থাকে। কেবল কুৎসিত নহে, গণতন্ত্রের পক্ষে ভয়ানক।
ভারতীয় গণতন্ত্র এখনও সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয় নাই। শাসকরা ছলে বলে কৌশলে তাহার সমস্ত শক্তি খর্ব করিতে ব্যগ্র, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করিবার উদ্দেশ্যে ভয়ের সাম্রাজ্য বিস্তারে তৎপর, কিন্তু সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন মহল হইতে সমালোচনা এখনও অব্যাহত। এমনকি প্রাক্তন বিচারপতি এবং অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসাররাও সেই সমালোচনা ও প্রতিস্পর্ধার শরিক হইতেছেন। বস্তুত, বিশিষ্ট রাজনীতিক ও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে দিল্লি পুলিশের তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ‘পশ্চাদপসরণ’ স্পষ্টতই এই প্রতিক্রিয়ার চাপে। কিন্তু ইহাতে আশ্বস্ত হইবার কিছুমাত্র কারণ নাই। চণ্ডনীতির দাপট যে কমে নাই এবং কমিবে না, তাহা আক্ষরিক অর্থেই রাষ্ট্রযন্ত্রের দৈনন্দিন কার্যকলাপে সুস্পষ্ট। প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে দানবীয় আইন প্রয়োগের ধারাবাহিক ইতিহাসে সাম্প্রতিকতম সংযোজন উমর খালিদের গ্রেফতারি এবং তাঁহাকে পুলিশের হেফাজতে রাখিয়া জেরা করিবার জন্য এগারো লক্ষ পাতার নথি দাখিল করিবার অতুল কীর্তি। অভিযোগ, মামলা, বিচার— সমস্ত প্রক্রিয়াই আইনি ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রকরণ। প্রশাসন সেই ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু সেই অঙ্গটি আপনাপন দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করিবে, ইহা গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত। তাহার পরিবর্তে প্রশাসন যদি আইনি প্রক্রিয়াগুলিকে আপন ক্ষমতার অপব্যবহারের উদ্দেশ্যে কাজে লাগাইতে তৎপর হইয়া উঠে, বিশেষ বিশেষ দমনমূলক আইন যদি রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়, তবে প্রশাসন পর্যবসিত হয় দুঃশাসনে, গণতন্ত্রের মুখোশ পরিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় স্বৈরতন্ত্র। কেবল দিল্লি পুলিশ নহে, নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহ যোগী আদিত্যনাথদের দেশ জুড়িয়া তাহার দুর্লক্ষণ প্রকট। ভারভারা রাও হইতে আনন্দ তেলতুম্বড়ে— রাষ্ট্রের সমালোচনা করিয়া মাসুল গনিবার তালিকাটি কেবল দীর্ঘ নহে, মর্মান্তিক। ক্রমাগত উদ্বেগের নূতন নূতন কারণ তৈয়ারি হইতেছে— উত্তরপ্রদেশে ‘বিশেষ সুরক্ষা বাহিনী’ তাহার এক তাজা দৃষ্টান্ত। বিচারবিভাগ বহুমুখী অন্যায়ের প্রতিকারে তৎপর হইবে, এমন ভরসা নাগরিকরা এখনও হারান নাই। কিন্তু শুধু সেই ভরসায় থাকিয়া সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব মিটিতে পারে না। শাসকের অনাচারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ জারি রাখা এখন অপরিহার্য।