জামিয়া মিলিয়ার পড়ুয়াদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ।
কোনও দূর প্রদেশ বা নিরালা প্রান্তে নহে, খাস রাজধানীর বুকের উপর রবিবার সন্ধ্যায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে পুলিশের যে হিংসাত্মক রূপ দেখা গেল, তাহার ছবি সঙ্গত কারণেই দেশেবিদেশে ছড়াইয়া পড়িতেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের বেশ একটি নূতন পরিচয়ও বিশ্বময় প্রচারিত হইতেছে। অকুস্থলটি যে হেতু দিল্লি, এই নূতন পরিচিতির গুরুত্ব বিরাট। সরাসরি এই পুলিশি দমনের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেই লইতে হইবে। প্রতিবাদরত ছেলেমেয়েরা বেধড়ক মার খাইয়াছে, বিরাট সংখ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হইয়াছে। সর্বাপেক্ষা বড় কথা, অনুমতি না লইয়াই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকিয়াছে, লাইব্রেরির মতো নিরাপদ জায়গায় ছাত্ররা আশ্রয় লইলে সেখানে ঢুকিয়া তাহাদের মারিয়াছে। রাস্তায় ফেলিয়া নিরস্ত্র তরুণকে একাধিক পুলিশ মিলিয়া মারিতেছে, সহপাঠীকে প্রাণপণ বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছে কতিপয় তরুণী— দেখিয়া শুনিয়া আতঙ্কের শিহরন বহিয়া যায়। জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটি, এবং তাহার পর আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রসমাজের উপর যে দমন-নির্যাতন দেখা গেল, তাহা তাই গভীর উদ্বেগ ও ত্রাসের বিষয়। সকলেই বুঝিতেছেন, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটি কত প্ররোচনামূলক। সমাজের বিভিন্ন অংশ হইতে এই বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উত্থিত হইতে পারে— বিশেষত মুসলিম সমাজের মধ্য হইতে, তাহা সরকারের অজানা থাকিবার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ যে এই সকল প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা লইতে পারে, তাহাও আন্দাজ করিবার কথা। প্রতিবাদ এমনকি হিংসাত্মক আকারও লইতে পারে, সে কথাও নিশ্চয় কল্পনাতীত ছিল না। তবে? বেদম প্রহার ব্যতীত আর কোনও ভাবে প্রতিবাদীদের নিরস্ত করা সম্ভব কি না, তাহা কি নেতামন্ত্রীরা বিবেচনা করিবার সময় পান নাই?
সম্ভবত ইহা তাঁহাদের বিবেচিত সিদ্ধান্তই বটে। কেননা গত কিছু কাল ধরিয়াই দেখা যাইতেছে, বিজেপি সরকার তাহার অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে বাছিয়া লইয়াছে ছাত্রসমাজকে। বৈষম্য কিংবা দক্ষিণপন্থার প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ প্রথম কথা কহে, তাই বোধ হয় প্রথমেই ছাত্রদের কণ্ঠ রোধ করাটা সরকারি কার্যক্রমের একটি আবশ্যিক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কয়েক দিন আগেই দিল্লির পথে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পুলিশের হাতে নৃশংস মার খাইতে দেখা গেল। গত সপ্তাহান্তে সেই দমন সোজাসুজি ঢুকিয়া আসিয়াছে বিবিধ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। পুলিশি আক্রোশের ভিডিয়ো জনগণের হাতে হাতে ঘুরিতেছে, কিন্তু পুলিশের বড়কর্তারা রুটিনমাফিক সাফাই দিতেছেন যে, গত্যন্তর ছিল না, ছাত্ররাই অতীব আক্রমণাত্মক হইয়া পড়ায় কঠোর পথ লইতে হয়। এখানে একটি কথাই বলিবার। যে হেতু ছাত্রদের হাতে লাঠি, কাঁদানে গ্যাস বা অন্য কোনও অস্ত্র ছিল না, এই হিংসার প্রাথমিক দায় তাহাদের হইতে পারে না। বাস্তবিক, নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের যে করুণ বিপন্নতা প্রচারমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়াছে, তাহা তর্কবিতর্কের অপেক্ষা রাখে না। পুলিশকর্তারা বলিয়াছেন, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরটি বেষ্টনী-আবৃত কোনও সংহত চত্বর নহে। ইহার অর্থও বোঝা মুশকিল। সংহত চত্বর না হইলেই কি ছাত্রদের উপর বলপ্রয়োগ করিবার অধিকার জন্মায়? আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁহাদের হাতে, তাঁহাদের আর এক বার মনে করাইয়া দেওয়া যাক— উন্মত্ত বিশৃঙ্খল জনতা ও বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীর মধ্যে একটি তফাত করিতেই হইবে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক দায়িত্ব, বিরোধীদের বিরোধিতা করিতে দেওয়া। গণতন্ত্র-মতে তাঁহারা ক্ষমতায় আসিয়াছেন, সেই ব্যবস্থার প্রতি তাঁহাদের দায়বদ্ধ থাকিতে হইবে।