সত্যবান চক্রবর্তী কিন্তু আসলে ছিলেন শেলিরই স্কাইলার্ক। কারণ তিনি নিজের জীবনে কখনও ডানে-বাঁয়ে তাকাননি। তাঁর জীবনের পথ একেবারে সরলরেখার মতোই সোজা। সততার প্রশ্নে, নীতির প্রশ্নে তিনি সর্বদা আপসহীন। আর তাঁর ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ ছিল যথাক্রমে-এরিথমেটিক-অ্যালজেবরা-জিয়োমেট্রি-কনিক সেকশন। ধরাধামে তাঁর যেন একটাই কাজ, অঙ্কের ক্লাস নেওয়া। ঝড়-ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতেও তিনি অবিচল। ক্লাস তাঁকে নিতেই হবে।
ক্লাসের প্রবেশের আগেই শোনা যেত তাঁর গলা—‘সিডাউন, সিডাউন বয়েজ! নাউ টেক ডাউন।’ এর পরেই বকের মতো পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতেন ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে। স্মৃতি থেকেই বোর্ডে লিখে দিতেন কোনও অঙ্কের প্রশ্ন। তবে ক্লাসে তিনি যে শুধু অঙ্কই করিয়ে যেতেন এমন ভাবলে ভুল হবে। প্রতিটি বিভাগের প্রত্যেক ছাত্রের নাম তাঁর স্মৃতিপটে রোল-নম্বর অনুযায়ী সাজানো থাকত। শুধু নাম নয়, তাদের হাঁড়ির তলদেশের খবরও।
এমন মানুষের সাংসারিক জীবন কদাচিৎ সুখের হয়। ‘প্যারাবোলা স্যার’ও তার ব্যতিক্রম নন। মেধাবী বড় ছেলে মারা গেল অকালে। স্ত্রী বারেবারেই তাঁকে ভুল বুঝলেন। ‘প্যারাবোলা স্যার’-এর সততার খেসারত দিয়ে জামাই জেলে গেলেন, ফলত মেয়ে প্রবল ভাবে অত্যাচারিত হলেন শ্বশুরবাড়িতে। আর সবচেয়ে দুঃখের ঘটনা, ছোটছেলের দ্বারা শেষ জীবনে বাড়ি ছাড়া হয়ে তিনি বাধ্য হলেন কাশীতে আশ্রয় নিতে। তবে তাঁর ভরসা বরাবরই তাঁর ছাত্রেরা। কাশীতে এক মন্দিরে জুতো পাহারার কাজে নিযুক্ত ‘প্যারাবোলা স্যার’কে উদ্ধার করে কলকাতায় নিয়ে এলেন তাঁর এক ছাত্রই।
এমন উপন্যাস পড়লে মনে তীর্থভ্রমণের আনন্দ হয়। আর সে আনন্দের রেশ সহজে কাটতেও চায় না। এ রকমই আর এক আশ্চর্য উপন্যাস ‘অনুবর্তন’। ‘অনুবর্তন’ অবশ্য শিক্ষালয়-কেন্দ্রিক উপন্যাস। বিভূতিভূষণ তো এই উপন্যাসের নামই দিয়েছিলেন ‘ক্লার্কওয়েল সাহেবের ইস্কুল’। এ রকম বিদঘুটে নাম বাজারে চলবে না, প্রকাশকদের তরফে গজেন্দ্রকুমার মিত্র এমন যুক্তি দেখিয়ে কৃষ্ণদয়াল বসুকে নিয়ে ‘অনুবর্তন’ নামটি পছন্দ করেছিলেন এবং লেখকের অনুমতি নিয়ে এই নামেই ছাপা হয়েছিল উপন্যাস। উপন্যাসের নাম নিয়ে আজ আর অবশ্য কিছু যায় আসে না। উপন্যাসের প্রথম পাতা থেকেই এমনই আকর্ষণ তৈরি হয় যে, পাঠক এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগই পায় না।
স্কুলের নাম ‘মডার্ন ইন্সটিটিউশন’। এই স্কুলের হেডমাস্টার ক্লার্কওয়েল সাহেব। দোর্দণ্ডপ্রতাপ, জাঁহাবাজ। মাস্টার, ছাত্র সমান ভাবে কাঁপে তাঁর দাপটে। কমিটির সদস্যেরা সকলে বাঙালি। হলে কী হবে? সাহেবকে খাতির করে চলা তাঁদের বহু দিনের অভ্যেস। সুতরাং স্কুলের মাস্টারদের ডিক্রি ডিসমিসের একমাত্র মালিক ক্লার্কওয়েল সাহেবই। নানা ধরনের শিক্ষক এখানে। নারানবাবু, কিছু পরে যোগ দেওয়া রামেন্দুবাবুর মতো দায়িত্বসচেতন শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনই আছেন যদুবাবু, ক্ষেত্রবাবুর মতো ফাঁকিবাজ শিক্ষক। এ ছাড়া আছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মি. আলম। ক্লার্কওয়েল সাহেবের ভাষায় যিনি ‘সিনসিয়ার টিচার’। তবে তাঁর এই সিনসিয়ারিটি কাজে কতটা জানা না গেলেও মাস্টারদের নামে হেডমাস্টারের কান ভারী করায় যে ষোলো আনা তা বোঝা যায় পদে পদে। হেডমাস্টারের দুই কান তাঁর জিম্মায়, ফলে শিক্ষকেরা তাঁকেও বেশ ভয় করেই চলতেন।
স্কুলের স্বল্প বেতনে জেরবার মাস্টারেরা। হেডমাস্টার, মি.আলম, আর নিচু ক্লাসে ইংরেজি পড়ানো তরুণী ফিরিঙ্গি মিস সিবসনের (যিনি ক্লার্কওয়েল সাহেবের সঙ্গেই থাকতেন) মাইনে বছর বছর বেড়ে চলত। কিন্তু অন্য শিক্ষকদের মাইনে দশ-পনেরো, এমনকি বিশ বছরেও ছিল দারু ব্রহ্মবৎ অনড় ও অচল। এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার সাহসও কোনও শিক্ষকের ছিল না। এমনিতেই কোনও শিক্ষকের একটু ফাঁকি নজরে এলেই ক্লার্কওয়েল সাহেবের ঘরে তাঁর ডাক পড়ত। মাইনে বাড়ানোর আবদার তুললে তো আর রক্ষে ছিল না।
শিক্ষকদের কাছে স্কুলটা ছিল কারাগার। এই কারাগারের জীবন কিন্তু লেখক নিজে সে জীবনের অংশীদার ছিলেন বলে মোটেই গুরুগম্ভীর ভাবে উপস্থাপন করেননি। অসংখ্য রসস্নিগ্ধ সিচুয়েশন তৈরি করেছেন যেগুলো পাঠককে এক মুহূর্ত উপন্যাসের পাতা থেকে সরতে দেয় না।
থার্ড পণ্ডিতের ঘটনাটাই বলা যাক। শেষ পিরিয়ডের দীর্ঘতায় অসহিষ্ণু হয়ে থার্ড পণ্ডিত জগদীশ জ্যোতির্বিনোদ অফিসে ঘড়ি দেখতে পাঠিয়েছিলেন একটি ছেলেকে। সে ছেলে তেমন চালাক-চতুর নয়। তাই ধরা পড়ে গেল খোদ ক্লার্কওয়েল সাহেবের কাছেই। স্কুল ছুটির পরে বসল বিচারসভা। এই বিচারসভায় ক্লার্কওয়েল সাহেবের বক্তব্য রাখার প্রসঙ্গে লেখক লিখছেন, ‘ক্লার্কওয়েল শিক্ষকদের সভায় অতি তুচ্ছ কথা বলিবার সময়ও জজ সাহেবের গাম্ভীর্য্য ও আড়ম্বর প্রদর্শন করিয়া থাকেন, বাজেট সভায় পেশ করিবার সময় অর্থসচিব যত না বাগ্মিতা দেখান তদপেক্ষা বাগ্মিতা দেখাইয়া থাকেন।’ যাইহোক জ্যোতির্বিনোদবাবু বিচারসভায় আপাতত কমিটির পরবর্তী মিটিং না হওয়া অব্দি সাসপেন্ড হলেন। সে সাসপেনশন অনেক কষ্টে মিস সিবসনকে ধরে কী ভাবে তিনি রদ করলেন তাও বেশ মজার। সামান্য বেতনে হিমসিম খাওয়া এই শিক্ষকের দলের বেশিরভাগই ছুটির পর দু’একটা টিউশন করেন। স্কুলের খাটুনি, টিউশন, তার উপর সংসারের চাপ। স্কুল তো এমনিতে ছুটি হওয়া অসম্ভব। হিন্দু কোনও পরবের জন্য তাঁরা মুখিয়ে থাকেন। ঘণ্টাকর্ণ পুজো, তালনবমী ইত্যাদির মতো সামান্য পরব সম্পর্কেও ক্লার্কওয়েল সাহেবের কাছে হেডপণ্ডিতকে দিয়ে বলানো হয়, এমন বড় পরব হিন্দুদের আর নেই। এবং সবই ‘নেক্সট টু দুর্গাপূজা।’ ধর্ম বড় স্পর্শকাতর বিষয়। মি.আলম বাগড়া দিতে পারেন না। ক্লার্কওয়েল সাহেবও প্রথমটায় হেডপণ্ডিতের আবেদন নাকচ করে পরে শেষ ঘণ্টায় সার্কুলার পাঠান ক্লাসে ক্লাসে—‘The school will remain closed…’
এমন রোজনামচায় ছন্দপতন হয় এক দিন। তাঁদের জীবন-জীবিকার চেনাজানা আখ্যানে হঠাৎ এসে পৌঁছয় বিশৃঙ্খল অরাজকতার প্রচণ্ড এক আঘাত। কলকাতায় জাপানিদের বোমা পড়বে— এমন গুজবে জনজীবন স্তব্ধ হতে থাকে। মানুষজন পালাতে থাকে দূর মফস্সলের দিকে। পলায়নের দলে যোগ দেন মডার্ন স্কুলের মাস্টাররাও। বোমা পর্বের পরে সব আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়, খোলে স্কুলও। দেখা যায়, দু-তিন জন বাদে ফিরেছেন সবাই। বিভূতিভূষণের এই উপন্যাসে স্কুলের নাম ‘মডার্ন ইনস্টিটিউশন’। উপন্যাস পাঠের পরে ‘মডার্ন’ শব্দটিকে পাঠক প্রতীকী ভাবলে ভুল কিছু করবেন না। কেননা মডার্ন স্কুলের এই কথকতা ‘দিন রাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস বর্ষ মন্বন্তর মহাযুগ পার হয়ে’ আজও প্রবল ভাবে বাস্তব। শুধু দেশ-কাল, পরিবেশ-পরিস্থিতিই একটু বদলে গিয়েছে, এই যা। (উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল