আদালতের নির্দেশ মান্য করিয়া পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি স্কুলগুলি কি এই বার ফি হ্রাসের পথে হাঁটিবে? সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও হাই কোর্টের রায়টি বহাল রাখিবার পরে স্কুলগুলির সামনে সম্ভবত অন্য কোনও উপায়ও নাই। কোভিড-কালে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি স্কুলগুলিকে ২০ শতাংশ টিউশন ফি কমাইতে হইবে বলিয়া ইতিপূর্বে রায় দিয়াছিল কলিকাতা হাই কোর্ট। যুক্তি ছিল, লকডাউনে বহু মানুষ কাজ হারাইয়াছেন। অপর দিকে, প্রাতিষ্ঠানিক খরচ কমিয়াছে স্কুলগুলিরও। সুতরাং, পরিস্থিতির প্রয়োজনে ফি কমাইতে হইবে। স্কুল বন্ধ থাকিবার কারণে যে সকল পরিষেবা হইতে পড়ুয়ারা বঞ্চিত হইতেছে, তাহার জন্য কোনও ফি আদায় করা চলিবে না। এই রায়ের বিরুদ্ধে বেসরকারি স্কুলগুলি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হইয়াছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টও হাই কোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয় নাই। ফলে, অভিভাবকদের স্বস্তি মিলিয়াছে।
স্বস্তির কারণ, লকডাউনে যাঁহারা চরম আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়িয়াছেন, পরিবারের আয় যাঁহাদের অনেক গুণ কমিয়াছে, তাঁহাদের অনেকের সন্তানই এই স্কুলগুলির পড়ুয়া। ফি-র বোঝা কিছু না কমিলে হয়তো অনেক শিশুর পঠনপাঠন বন্ধ হইত। এই রায়ের পর হয়তো সেই সিদ্ধান্ত অভিভাবকেরা পুনর্বিবেচনা করিবেন। অনেক শিশু মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ হইবার হাত হইতে বাঁচিবে। তবে, স্কুলের যুক্তিটিও অগ্রাহ্য করিবার নহে। স্কুল না বসিলেও তাহাদের শিক্ষক-অশিক্ষকদের বেতন দিতে হইতেছে। অন্য বহু খরচও তেমন কমে নাই। তৎসত্ত্বেও কিছু স্কুল পূর্বেই ফি হ্রাসের বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত লইয়াছিল। কিন্তু সকলকে ২০ শতাংশ ফি হ্রাস করিতে হইলে হয়তো অনেক স্কুলই সমস্যায় পড়িবে। হয়তো পাকাপাকি ভাবে ঝাঁপ পড়িবে বেশ কিছু অনামী ছোট স্কুলের।
এক্ষণে উপায় কী? এইখানে সমগ্র বিষয়টি মানবিক দিক হইতে দেখিবার প্রয়োজন। বিদ্যালয় নিছক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নহে। সুতরাং, এই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র লাভ-ক্ষতির অঙ্ক চলিবে না। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা কিনিবার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে না। তাহারা বৃহদর্থে প্রতিষ্ঠানের অংশ হইয়া যায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়িয়া উঠে এক পারিবারিক বন্ধন। পরিবারের এক জন যখন বিপদগ্রস্ত, তখন মানবিক দিক হইতেই অন্যকে তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে হইবে, ভরসা জোগাইতে হইবে। ফি কমিলে স্কুলের আর্থিক দিকটি ক্ষতিগ্রস্ত হইবে, সত্য। কোন স্কুল কী ভাবে তাহার মোকাবিলা করিবে, তাহা আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা যাইতে পারে। প্রয়োজনে অভিভাবকদেরও সেই আলোচনায় শামিল করা যাইতে পারে। কিন্তু বিষয় যখন পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ, তখন স্কুল যদি বিপর্যয়ের দিনেও তাহার প্রতি সাহায্যের হাতটি প্রসারিত না করে, তবে আর কে করিবে? এমনিতেই অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বিভেদরেখা স্পষ্ট হইয়াছে। সেই বিভেদকে আরও চওড়া করিবার পথটি পরিহার করাই বিধেয়। অন্যথায়, শিক্ষা সকলের অধিকার— কথাটির কোনও মূল্য থাকিবে না। অতিমারি নানা দিকে সঙ্কটের সূচনা করিয়াছে। ফি লইয়া বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রেও সঙ্কট দেখা দিলে, তাহা মর্মান্তিক হইবে।