Cyclone Amphan

দুঃসহ

বন্যা, খরা, মহামারি, মন্বন্তর এ রাজ্য কম দেখে নাই। তথাপি কোভিড-১৯ ও আমপানের যৌথ আক্রমণে যে ঘোর দুর্বিপাক সৃষ্টি হইল, তাহার তুলনা সহজে মেলে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২০ ০০:০২
Share:

দুর্দিন এমনই। তাহার উচিত-অনুচিত বিচার নাই, আতুর-অনাথ বিবেচনা নাই, সময়-অসময়ের বোধ নাই। দুঃখের উপর দুঃখ, ক্ষতির উপর ক্ষতি করিয়া সে যখন বিদায় নেয়, তখন কোথাও সান্ত্বনার লেশমাত্র চোখে পড়ে না। কেবল চিতাগ্নি হইতে উত্থিত স্ফুলিঙ্গের ন্যায় একটি প্রশ্ন ঘুরিয়া ঘুরিয়া উড়িতে থাকে— কেন, কেন? আমপানের ধ্বংসলীলা দেখিয়া রাজ্যবাসীর মন যেন অবশ হইয়াছে। একেই মহামারির প্রকোপে জনজীবন অবরুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মসংস্থানহীন। গৃহস্থের ঘরে অর্থ নাই, অন্ন নাই। বাহিরে মারণরোগ কালনাগের ন্যায় ফণা তুলিয়াছে। ঘরে ঘরে স্বজনবিয়োগের ক্রন্দন। এখনই কি এই প্রবল ঝঞ্ঝাকে আসিতে হইল? যেন এক উন্মত্ত দানব দক্ষিণবঙ্গের শত সহস্র মানুষের শেষ আশা ফুৎকারে নিভাইয়া দিল। আজ তাহাদের গৃহ বিধ্বস্ত, ফসল বিনষ্ট, জমি লবণাক্ত, অনুর্বরা। বন্যা, খরা, মহামারি, মন্বন্তর এ রাজ্য কম দেখে নাই। তথাপি কোভিড-১৯ ও আমপানের যৌথ আক্রমণে যে ঘোর দুর্বিপাক সৃষ্টি হইল, তাহার তুলনা সহজে মেলে না। কী করিয়া প্রবল অনিষ্টকে সহিবে রাজ্য, অপরিমিত ক্ষতি কী করিয়াই বা পূরণ করিবে? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আমপানের তাণ্ডব দেখিয়া ‘সর্বনাশ’ হইবার আক্ষেপ করিয়াছেন। বারংবার দুর্দৈবের পীড়নে ধৈর্যচ্যুতি অস্বাভাবিক নহে। বহু বৎসর পূর্বে এক রাজ্যচ্যুত, লাঞ্ছিত সম্রাজ্ঞী বনবাসের গ্লানি সহিতে না পারিয়া স্বামীকে বলিয়াছিলেন, ‘‘বিধাতা প্রাণিগণকে মাতা-পিতার দৃষ্টিতে দেখেন না, তিনি রুষ্ট ইতর জনের ন্যায় ব্যবহার করেন।’’ বহু দেশের পুরাণকাহিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দেবতার রোষ বলিয়া কল্পনা করিয়াছে। ভারতের দুই প্রাচীন মহাকাব্য এত সহজ পথ লয় নাই। দুর্ভাগ্যের অকস্মাৎ, অকল্পনীয় প্রহারে পীড়িত হইয়াও কর্তব্যে অবিচলতা, ইহাই রামায়ণ-মহাভারতের উপজীব্য।

Advertisement

কিন্তু রামায়ণ-মহাভারত কাব্যই, শাস্ত্র নহে। তাই কর্তব্যের নিরুপণে তাহাদের সমাপ্তি নহে। মানুষ বার‌ংবার এই দুই মহাগ্রন্থের নিকট ফিরিয়া যায়, কারণ যত সুতীব্র, সান্ত্বনাতীত শোকের বিবরণ ছড়াইয়া রহিয়াছে এই দুই কাহিনিতে, তাহার তুলনা কমই আছে। ধর্ম-অধর্ম, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার শেষ অবধি ডুবিয়া যায় বিলাপে। গান্ধারী সর্বদাই ধর্মের জয় ঘোষণা করিয়াছেন, কিন্তু কুরুক্ষেত্রে ধর্মযুদ্ধের অবসানে চক্ষের আবরণ খুলিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে স্বপক্ষ-বিপক্ষ ভুলিলেন, শতপুত্রের শোকও যেন নগণ্য হইয়া গেল। পাণ্ডব ও কৌরব, উভয়পক্ষের নারীরা ছিন্নভিন্ন দেহের স্তূপের মধ্যে স্বামী-পুত্রকে সন্ধান করিয়া ফিরিতেছেন। কেহ উন্মত্তের ন্যায় স্বামীর ছিন্ন মস্তকের সন্ধান করিতেছেন, কেহ পতির শ্বাপদভুক্ত দেহ দেখিয়া অজ্ঞান হইয়া ভূমিতে পড়িতেছেন, কেহ প্রিয়জনের গলিত দেহে হাত বুলাইতেছেন। চিরবিচ্ছেদের বেদনা সর্বদাই অসহ্য। কিন্তু মৃত্যু এমন বীভৎস, সর্বগ্রাসী রূপ লইয়া আসিলে শোকের নিভৃত পরিসরটুকু ধ্বংস হয়। তখন মৃত্যুকে জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি বলিয়া শান্ত ভাবে গ্রহণ করা কঠিন হয়। শোক চিত্তকে বিক্ষুব্ধ করে, তাহার অভিঘাত জনমানসকেও আলোড়িত করে।

কোভিড-১৯ তেমনই আন্দোলিত করিয়াছে ভারতকে। মৃতের প্রতি যে সম্ভ্রম সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন, তাহা নস্যাৎ হইয়াছে। হাসপাতালের নিরীক্ষণ কেন্দ্রে মৃতের পাশের শয্যায় স্থান হইতেছে জীবিতের। মৃতদেহ সরাইবার অবসর নাই। যে প্রিয়জনের কুশলসংবাদ জানিতে বারংবার হাসপাতালে ফোন করিতেছেন উৎকণ্ঠিত আত্মীয়েরা, সেই ব্যক্তির দাহ হইয়া গিয়াছে। পরমাত্মীয়কে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের, শেষ বিদায় জানাইবার উপায় নাই। পরিযায়ী শ্রমিকদের গাড়ি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হইলে মৃতদেহ-বাহী গাড়িতে স্থান হইতেছে আহতদেরও। মৃতের সহিত যাত্রা করিতেছে জীবিত, যত ক্ষণ না অপর বাহন মেলে। রেলপথে নিদ্রিত শ্রমিকদের ট্রেন-পিষ্ট হইয়া মৃত্যু, মালবাহী ট্রাক উল্টাইয়া মৃত্যু, দীর্ঘ পথ হাঁটিবার শ্রমে পথপার্শ্বে মৃত্যু, এই সকলই জীবিতদের বিপন্ন করিতেছে। এখন আমপান ঝঞ্ঝা আরও দেহ গনিতে বাধ্য করিল। ছিন্ন বিদ্যুৎবাহী তারে তড়িতায়িত জলে পদক্ষেপ মাত্র জীবিত পরিণত হইয়াছে মৃতে, এ কথা ভাবিলে স্নায়বিক ত্রাসে প্রাণ কাঁপিতে বাধ্য। এই মরণ-মহোৎসব কী করিয়া মন গ্রহণ করিতে পারে? যুদ্ধশেষে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে মনে করাইয়াছেন, সকল সঞ্চয়ই ক্ষয় হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়। সত্য বটে। কিন্তু মহামারি, মহা-দুর্যোগে যে অজস্র মৃত্যু, তাহার নিরাবরণ, অমানবিক রূপ বড়ই দুঃসহ।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

ফোড়া হলে, তা থেকে মানুষের মন সরিয়ে দেওয়ার দুটো উপায়। এক, ফোড়াটার নিরাময়। দুই, পাশে ওর চেয়ে বড় ফোড়া গজিয়ে দেওয়া। হয়তো সেই সূত্র মেনেই, ঠিক যখন করোনা নিয়ে আমরা পৃথিবীর প্রকাণ্ডতম টেনশন করছি, আমপান এসে এমন তছনছ করল, লোকে ‘নিকুচি করেছে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর’ বলে কাঁধ লাগিয়ে গাছ সরাতে ব্যস্ত। আমপান নিয়ে আমরা বৃহৎ হইচই না করি, তা হলে হয়তো পঙ্গপাল নামবে, বা ভিন গ্রহের উড়ন্ত চাকতি থেকে নিষ্ঠুর বাহিনী!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement