সিইএসসি-র পাঠানো ‘বকেয়া’ বিদ্যুৎ-বিল হাতে পাইয়া নগরবাসী কী ভাবে ‘বিদ্যুৎস্পৃষ্ট’ হইয়াছেন, এত দিনে তাহা পরিচিত কাহিনি।
দুই কদম অগ্রসর হইয়া এক কদম পিছাইয়া আসিলে এক পদক্ষেপের অগ্রগতি লাভের ঘরে জমা পড়ে। লাদাখের সীমান্ত-সমস্যা হইতে পাড়ার মুদির দোকানে দর কষাকষি পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই এই কৌশল প্রযোজ্য। আপাতত মোটা অঙ্কের বকেয়া বিল আদায় করিবার জন্য সিইএসসি-র আচরণকেও সেই পর্যায়ে ফেলা চলে। গ্রাহকদের প্রতিবাদের মুখে সন্দেহজনক বিলের বকেয়া টাকা আপাতত না দিবার কথা বলিলেও সেই টাকা পরে নেওয়া হইবে কি না, বা বিলগুলি সংশোধন করা হইবে কি না, সেই মূল বিষয়ে তাহারা এখনও মূক। ফলে আপাত ভাবে একটু পিছাইয়া পুনরায় আগে বাড়িবার সুযোগ তাহাদের সামনে উন্মুক্ত। সিইএসসি-র পাঠানো ওই ‘বকেয়া’ বিদ্যুৎ-বিল হাতে পাইয়া নগরবাসী কী ভাবে ‘বিদ্যুৎস্পৃষ্ট’ হইয়াছেন, এত দিনে তাহা পরিচিত কাহিনি। সাধারণ ভাবে কোনও বাড়িতে যত টাকার বিদ্যুৎ বিল আসে, তদপেক্ষা কয়েক গুণ বেশি অঙ্কের হিসাব কেন ধার্য করা হইল, তাহার জবাব অবশ্যই প্রস্তুত। সেই জবাব বলিতেছে, লকডাউনের কারণে দুই মাস বাড়ি বাড়ি মিটার দেখিয়া বিদ্যুতের ব্যবহৃত ইউনিট নির্দিষ্ট করা যায় নাই। তাই বিগত ছয় মাসের গড়পড়তা কষিয়া বিল গিয়াছিল এবং তাহা নাকি ছিল ন্যায্যত দেয় টাকার পরিমাণ হইতে কম। এখন সব বকেয়ার হিসাবনিকাশ করিয়া নাকি সঠিক বিল পাঠানো হইয়াছে! অর্থাৎ গ্রাহকদের ক্ষোভ, অভিযোগ গোড়াতেই অযৌক্তিক বলিয়া দাগাইয়া দেওয়া গিয়াছে। মনে হইতেই পারে, উপভোক্তাদের অভিযোগ মীমাংসার প্রয়োজনীয়তা খোলা মনে মানিয়া লইতে বৃহত্তর কলিকাতার এই একমেবাদ্বিতীয়ম্ বিদ্যুৎবণ্টন সংস্থাটি দ্বিধাগ্রস্ত। অন্যথায় গ্রাহকদের স্কন্ধে চাপানো বিলের বোঝা কবে এবং কী ভাবে লাঘব করা যাইবে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণার জন্য সিইএসসি কর্তৃপক্ষ এত কালক্ষেপ করিতেন না। গ্রাহকদেরও এত চাপে ফেলিয়া রাখিতেন না। সিইএসসি-র মতো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং অত্যাবশ্যক একটি সংস্থার পক্ষে গ্রাহকদের স্বার্থের প্রশ্নে এই রূপ গয়ংগচ্ছ এবং একরোখা মানসিকতা অতীব দুর্ভাগ্যজনক।
বিপুল অঙ্কের বিলের বিরুদ্ধে গ্রাহককুল প্রতিবাদে সরব হইবার পরেও তাহাতে আমল না দিয়া সিইএসসি প্রথমে বলিয়াছিল, টাকা বড় জোর তিন কিস্তিতে দেওয়া যাইতে পারে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদের প্রাবল্যেই হউক, বা রাজ্যে ক্ষমতাসীনদের ধমকানিতেই হউক, সিইএসসি আগের ঘোষণা হইতে সরিয়া সংশোধিত সিদ্ধান্তে যাহা জানাইয়াছে, তাহাও আদৌ স্বচ্ছ নয়। যে গ্রাহক সাধারণ ভাবে দুই-পাঁচ শত বা দুই-পাঁচ হাজার টাকার বিল পাইয়া থাকেন, কোন সরলাঙ্কে মাত্র দুই মাস মিটার না দেখার কারণে তাঁহার বকেয়া টাকার পরিমাণ দশ-বিশ-চল্লিশ হাজারে দাঁড়ায়, সেই জবাবদিহির নৈতিক দায় সিইএসসি অস্বীকার করিতে পারে না।
গ্রাহকদের উপর সিইএসসি-র সিদ্ধান্ত একতরফা চাপাইয়া দেওয়ার পিছনে সম্ভাব্য কারণ হইল বিদ্যুৎ বণ্টনে একচ্ছত্র আধিপত্যের ঔদ্ধত্য। শহর কলিকাতা ও সংলগ্ন কিছু এলাকায় আনুমানিক তেত্রিশ লক্ষ বিদ্যুৎগ্রাহক সিইএসসি-র মুখাপেক্ষী থাকিতে বাধ্য। সাম্প্রতিক অতীতে আমপান-দুর্যোগের সময় শহর জুড়িয়া বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পরেও সংস্থাটির ভূমিকা বিতর্কের ভরকেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছিল। যথোপযুক্ত প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তাহাদের ঘাটতি সেই সময় নিদারুণ ভাবে প্রকাশ হইয়া পড়ে। জনরোষ বাড়িতেছে বুঝিয়া অবশেষে বিদ্যুৎ সংস্থাটির বিরুদ্ধে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী কড়া হুঁশিয়ারি দেন। আশার কথা, এই বার বিদ্যুৎ বিলে যথেচ্ছাচারের অভিযোগ উঠিতেই সরকার কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করিয়াছে। কিন্তু দ্রুত ও স্বচ্ছ সমাধানের বিষয়টিতেও সরকারি হুঁশিয়ারির আঙুল উঠা জরুরি। গৃহস্থ স্বস্তি না পাইলে কিন্তু আলোর নীচে আঁধারের অভিযোগ ঘনীভূত হইতে থাকিবে।