বাংলাদেশ, আমার বাংলা দেশ

প্রাঙ্গণের একটি কোণে তরুণ, উৎসাহীরা বিক্রি করছে পিঠেপুলি, সুবাস ভেসে আসছে এই কোণ থেকে। চিতই পিঠে খেতে খেতে শোনা যাচ্ছে সংগীতের মূর্ছনা।

Advertisement

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:২৯
Share:

ঢাকার বাংলা একাডেমির বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে বর্ণালি আলোর রোশনাই। সেই আলো থেকে থেকে নিবদ্ধ হচ্ছে প্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান কয়েকটি প্রতিকৃতির উপর: মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জসিমউদ্দিন, শামসুর রাহমান। নবারুণ ভট্টাচার্যের মুখাবয়বও ঝলমল করছে, নীচে উদ্ধৃত তাঁর কয়েকটি পঙ্‌ক্তি: ‘‘আমার বিনাশ নেই—/ সুখে থাকবো দুঃখে থাকবো,/ সন্তান জন্মে সৎকারে... বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন/ মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন।’’

Advertisement

প্রাঙ্গণের একটি কোণে তরুণ, উৎসাহীরা বিক্রি করছে পিঠেপুলি, সুবাস ভেসে আসছে এই কোণ থেকে। চিতই পিঠে খেতে খেতে শোনা যাচ্ছে সংগীতের মূর্ছনা। রবীন্দ্র মঞ্চে সমবেত শিল্পীরা গাইছেন চারণকবি মুকুন্দদাসের গান, লালন মঞ্চে কলকাতার শিল্পী শ্রাবণী সেন তখন গাইছেন, ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো...’ একশো শতাংশ বঙ্গীয় পরিবেশ। এই পরিবেশকে স্মরণে রেখে প্রাবন্ধিক বদরুদ্দিন উমর বলেছিলেন, বাঙালির ঘরে ফেরা সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রত্যাবর্তন কতটা গভীর, কতটা ব্যাপক, অনুভব করছিলাম এই প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে।

ঢাকার সন্ধ্যাকাশের নীচে, হাড়কাঁপানো উত্তুরে হাওয়া আত্মস্থ করে তখন ভাবছি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আর শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামের কথা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যে লড়াইয়ের শুরু, তা আজও বহমান। এই সংগ্রামকে সালাম জানিয়ে এক উৎসাহী ছাত্র দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘‘আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু আরও অনেকটা পথ যেতে হবে। এখনও মধ্যে মধ্যে মৌলবাদ জিঘাংসু হয়ে উঠছে, কলুষিত করতে চাইছে আমাদের ভালবাসার অর্জনকে। আগামী নির্বাচনে এদের পর্যুদস্ত করতেই হবে।’’ এই মৌলবাদীরাই পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলা ভাষা ও বাংলা সৃজনকে দলিত করতে চেয়েছিল। শামসুর রাহমান কথিত দুঃখিনী বর্ণমালাকে অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে।

Advertisement

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা এই প্রতিরোধকেই গুরুত্ব দেন সুতীক্ষ্ণ উক্তিতে। স্মৃতিকে সজাগ রেখে তিনি বললেন, ‘‘আয়ুব খানের প্রতিনিধি মোনায়েম খান মহম্মদ আবদুল হাই-কে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সুপণ্ডিত অধ্যাপককে বলেছিলেন, ‘এই রবীন্দ্রসংগীত বস্তুটি কী, এটিকে নিয়ে আপনাদের এত মাতামাতি কেন? আপনি নিজে কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীত লিখতে পারেন না?’ আবদুল হাই বলেছিলেন, ‘লিখতে তো পারি। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমি যা লিখব, তা রবীন্দ্রসংগীত হবে না। হবে হাইসংগীত।’ এমনকী ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’-র মতো নিষ্পাপ, নির্বিরোধী পঙ্‌ক্তিকেও ‘পরিমার্জনা’(!) করে মৌলবাদীরা লিখেছিলেন, ‘‘ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি।’’ বিদঘুটে দৃষ্টান্তগুলি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘‘ভাষাই আমাদের ভিত্তি, আমাদের স্বপ্ন। এই উপমহাদেশে একমাত্র একটি দেশ ভাষাকে কেন্দ্র করে, আঁকড়ে ধরে গড়ে উঠেছে, সেই দেশ হল বাংলাদেশ।’’ এই দাবি কতটা সংগত, তা প্রতি মুহূর্তে প্রমাণিত হচ্ছিল সম্মেলন প্রাঙ্গণে। ভারত থেকে আগত প্রতিনিধি ও অংশগ্রহণকারীদের আপন করে নিচ্ছিলেন উদ্যোক্তা ও কর্মীরা। লেখক রাজু আলাউদ্দিন প্রশ্ন করলেন, ‘‘বাঙালিদের সাহিত্য-সংস্কৃতির এই বিরাট উৎসবে শঙ্খ ঘোষ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এলেন না কেন? এঁরা দু’জনেই প্রণম্য। এঁদের কবিতা ও প্রবন্ধ আমাদের আলোকিত করে।’’

সত্যি, পশ্চিমবঙ্গের লেখক-শিল্পী ও অন্যান্য অতিথিদের আপ্লুত করেছিল এঁদের অন্তরঙ্গতা, এঁদের অতিথিবাৎসল্য। প্রত্যেকেই তৃপ্ত, উজ্জীবিত বোধ করেছিলেন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। বস্তুত, প্রতিটি সেমিনারে ভারতের বাঙালিদের জোরালো উপস্থিতি প্রমাণ করেছিল, আমাদের ঐতিহ্য এক ও অভিন্ন। এবং, ঐতিহ্যের প্রতি এই সমবেত অঙ্গীকার কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে স্বীকার করে না, কোনও সীমানা বিভাজনকে গুরুত্ব দেয় না। তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম যে কত বার উচ্চারিত হয়েছিল, তা গুনে শেষ করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তো নিরন্তর ঘুরে ঘুরে এসেছিলেন ধ্রুবপদের মতো।

বিদায়ী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সৃজনের-বিশ্লেষণের এই উৎসব প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন, ‘‘নায়কেরা নয়, ইতিহাস রচনা করেন লেখক শিল্পীরা। পরীক্ষা পাশের জন্য দিগ্বিজয়ী বীরদের নিয়ে পড়াশোনা করা যায়, পাশের পর সে-সব বেমালুম ভুলে যাই। কিন্তু শিল্পীর ছবি, কবির কবিতা বা প্রিয় উপন্যাস কখনও ভোলা যায় নাকি! যে গান, সানাই বা সরোদের সুর আমাদের প্রিয়, তা কখনও ভুলতে পারি আমরা?’’ উল্লেখনীয়, বহু দিন আগে ফ্রিডরিশ এঙ্গেলস বলেছিলেন, ফ্রান্সের রয়ালিস্টরা রাজন্যের ইতিহাস জানতে চাইলে এবং ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, তার পূর্ববাণী পেতে চাইলে আমাদের পড়তে হবে বালজাকের উপন্যাস। রাজা ও সেনানায়কদের অবদান অতিক্রম করে বালজাক দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন সাধারণ মানুষের বিচিত্র জীবনপ্রবাহের উপর। তাদের যন্ত্রণা ও আনন্দ, তাদের সুখ-দুঃখের ইতিবৃত্তই ইতিহাসকে মূর্ত করে তোলে। বাংলাদেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎও অম্লান-অটুট রূপ পরিগ্রহ করেছে সৃজনে-সৃষ্টিতে।

সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেকের দাবি, সৃজন-সাহিত্য-সংস্কৃতি এক অপরিহার্য হাতিয়ার, যাকে ব্যবহার করতে হবে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠার জন্য। সৃজনের শত্রু হল উগ্রপন্থা ও বিষময় সাম্প্রদায়িকতা। বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে সংসদীয় নির্বাচন। বাংলা একাডেমি উগ্রপন্থা ও সাম্প্রদায়িকতার ঘোর শত্রু। সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘‘আমরা সকল প্রকার বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্বসংঘাতের বিরোধী এবং তাই বিশ্বশান্তির পক্ষে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করছি।’’ নির্বাচনের শেষে ফল ঘোষণার পরেও কি বাংলা একাডেমির বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে জ্বলে উঠবে আলোর রোশনাই?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement