ব্রিগেডে এবং ব্রিগেডের বাইরে

ভেবেছিলাম, ব্রিগেডে যাব। শেষ অবধি যাওয়া হয়নি। আফশোস থাকবে। অন্তত একুশ শতকে কলকাতার ময়দানে এমন সমাবেশ অ-ভূতপূর্ব। ভিড়ের মাথা গুনতি করে সাফল্য মাপবার ছেলেমানুষি অর্থহীন।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

ভেবেছিলাম, ব্রিগেডে যাব। শেষ অবধি যাওয়া হয়নি। আফশোস থাকবে। অন্তত একুশ শতকে কলকাতার ময়দানে এমন সমাবেশ অ-ভূতপূর্ব। ভিড়ের মাথা গুনতি করে সাফল্য মাপবার ছেলেমানুষি অর্থহীন। কিন্তু টিভির পর্দায়, সংবাদপত্রের পাতায়, সমাজমাধ্যমে ভেসে আসা অজস্র ছবিতে টকটকে লাল জনসমুদ্র দেখে যে আনন্দের স্বাদ পেয়েছি, তাকে অস্বীকার করি কী করে? আনন্দের হাটে ছেলেমানুষের মতো কে চলিতে পারে আর?
জানি, রাজনীতির ময়দান ছেলেমানুষির জায়গা নয়। জানি, বামফ্রন্ট আর বামপন্থার মধ্যে ব্যবধান বিস্তর, হয়তো অসেতুসম্ভব। জানি, রবিবারের মঞ্চ জুড়ে যাঁরা বিরাজ করছিলেন তাঁদের অনেকেই এ রাজ্যে বহুকাল লাগাতার রাজত্ব করেছেন, যে রাজত্বের ইতিহাস বিপুল কলঙ্কে লাঞ্ছিত। তাঁদের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক এই যে, মানবজমিন আবাদ করার সুবর্ণসুযোগ পেয়েও তাঁরা— সোনা ফলানো দূরে থাক— যত দিন গেল, শাসন যত কায়েম হল, ততই প্রবল থেকে প্রবলতর তৎপরতায় বিষবৃক্ষের চাষ করে গেলেন, দুর্ভাগা বঙ্গবাসী এখন যার ফল কুড়োচ্ছে। ব্রিগেডের মঞ্চে ভূতপূর্ব শাসকদের মুখে যে বৈপ্লবিক কথামালা শোনা গেল, তার অনেকটাই প্রশিক্ষিত স্লোগানমাত্র, সে কথাও অজানা নয়।
কিন্তু তার পরেও বলব, এই সমাবেশ অ-সামান্য। তার কারণ পরস্পরকে কমরেড বলে ডাকা নেতারা নন, তাঁদের বহুচর্চিত শব্দে ও বাক্যে সাজানো বক্তৃতা নয়, এমনকি, শেষ বিচারে, উদ্বেল জনসমুদ্রও নয়। তার কারণ একটা বিশ্বাস, একটা আস্থা, যা ওই মানুষগুলোকে, অন্তত তাঁদের একটা বড় অংশকে, সে দিন রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে কলকাতার ময়দানে টেনে এনেছে। বামপন্থায় বিশ্বাসী এমন অনেক সহনাগরিকের কথা জানি, যাঁরা বহু দিন, গত শতক থেকেই, বামফ্রন্টের মিছিলে সমাবেশে যাননি, কারণ যাওয়ার আর কোনও অর্থ তাঁদের কাছে ছিল না। কেউ ক্ষোভে, কেউ ঘৃণায়, কেউ বা গভীর হতাশায় থেমে গিয়েছিলেন, সরে গিয়েছিলেন। তাঁরা আবার ফিরে এলেন কি না, জানি না, হয়তো তাঁরাও জানেন না। কিন্তু সে দিন তাঁরা অনেকেই চেনা কবিতায় অচেনা শব্দের মতো উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলেছেন, ‘‘ব্রিগেডে যাওয়া দরকার।’’
এই বোধটাই অভূতপূর্ব। এর মধ্যে কোনও প্রাপ্তিযোগের আশা নেই— বামফ্রন্ট অদূর বা দূরতর ভবিষ্যতে ক্ষমতায় ফিরবে, নিতান্ত আহাম্মক ছাড়া এ-কথা কেউ মনে করে না। বড় ক্ষমতার অমৃতকুম্ভ দূরে থাক, ছোট ক্ষমতার হাঁড়িকলসিও আপাতত নাগালের বাইরে। এমনকি কোনও জনমোহন নেতা বা জনমোহিনী নেত্রীর আকর্ষণও ছিল না। তবু এই আদিগন্ত বিপুল তরঙ্গ। এ কেবল ফেব্রুয়ারির রোদ পোহানোর জন্য হতে পারে না, সে সত্য বোধ করি অতি বড় বাম-বিদ্বেষীও আয়নার কাছে স্বীকার করেছেন। একটা সুস্থ সমতার পথে উত্তরণের আদর্শ, একটা সহনীয় পৃথিবী তৈরি করার ধারণা, বিদ্বেষ আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার একটা অন্তর-নিহিত তাগিদ আজও বহু মানুষকে সচল করতে পারে— এই উপলব্ধি শ্রদ্ধা জাগায়, ভরসা দেয়। বামপন্থী দল বা নেতা বলতে যা বুঝি, তাঁরা এই শ্রদ্ধার কতটা মর্যাদা দিতে পারবেন, এই ভরসা কতটুকু রাখতে পারবেন, জানি না। কিন্তু রবিবারের ব্রিগেডের দৃশ্য ও ধ্বনি জানাল, পথ ফুরিয়ে যায়নি।
এবং, এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করা দরকার, পথ সুগম নয়। ময়দানে জনসমুদ্র, আকাশ জুড়ে লাল পতাকা, বাতাসে প্রতিধ্বনিত সমস্বর, সমাজমাধ্যমে অজস্র ছবি এবং কিছু দৃপ্ত বক্তৃতার দ্রুত থেকে দ্রুততর বেগে ছড়িয়ে-পড়া— এ সবই অসতর্ক মনে একটা বিভ্রম জাগাতে পারে। এই বিভ্রম যে, অন্ধকার কেটে গিয়েছে, এ বার আলো আপনিই আসবে। এই বিভ্রমের কারণেই হয়তো প্রচারমাধ্যম সম্পর্কে একটা অলীক প্রত্যাশারও সৃষ্টি হয়। এই প্রত্যাশা যে, ব্রিগেডের সভা ‘বড় খবর’ হবে। প্রত্যাশার পায়ে পায়ে আসে আশাভঙ্গ, ক্ষোভ, পবিত্র ক্রোধ। হিসেবনিকেশ চলে— ব্রিগেডের সভায় টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার আলো কত ক্ষণ পড়ল, এ-সমাবেশ পত্রপত্রিকায় কত বিঘে বা ক’ছটাক জায়গা পেল, ক্ষণজীবী শীতের সূর্য পাটে বসতে না বসতেই নির্জলা বঙ্গীয় কুনাট্য সংবাদের পরিসরকে কতখানি গ্রাস করে নিল। এই বাদপ্রতিবাদ স্বাভাবিক, হয়তো অনিবার্য। কিন্তু সেই শোরগোলে গোড়ার কথাটা যেন ঢাকা পড়ে না যায়।
গোড়ার কথাটা এই যে, অচলায়তন ভাঙার যে লড়াই, অচলায়তন তার হয়ে প্রচার করবে না, তার কণ্ঠ রোধ করতেই চাইবে। অচলায়তনের কাছে যতটা জমি, যতখানি আলো আদায় করে নেওয়া যায়, নিতে হবে, সেটাও লড়াইয়ের অঙ্গ, অবশ্যই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হয়। নিজের জমি নিজেকেই তৈরি করতে হয়। ব্রিগেডে এবং ব্রিগেডের বাইরে।

Advertisement

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement