সম্পাদকীয় ১

আশার শিখা

রবিবারের সিপিআই(এম) আয়োজিত সমাবেশটি আয়োজকরা সফল বলিয়া মনে করিতেছেন। সম্ভবত তাঁহাদের প্রত্যাশার সীমা ছাপাইয়া গিয়াছে সে দিনের সাফল্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

রবিবারের সিপিআই(এম) আয়োজিত সমাবেশটি আয়োজকরা সফল বলিয়া মনে করিতেছেন। সম্ভবত তাঁহাদের প্রত্যাশার সীমা ছাপাইয়া গিয়াছে সে দিনের সাফল্য। এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হইতে বলা যাইতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের পক্ষেও ইহা দস্তুরমতো সাফল্যের লক্ষণ। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানী কলিকাতার ব্রিগেড উদ্যান দুইটি ‘সফল’ সমাবেশ দেখিল— একটি সমাবেশ শাসক দল দ্বারা সংগঠিত, অন্যটি বিরোধী দল দ্বারা আয়োজিত! গণতন্ত্রের এই সার্বিক অবক্ষয়ের দিনে ইহা কম গৌরবের কথা নহে। প্রথম সমাবেশটিতে তারকা-সমাহার ছিল চোখ ধাঁধাইবার মতো, তেমনই ছিল গোটা শহর অচল করিয়া দেওয়া মানুষের ভিড়। দ্বিতীয়টিতে তারকাদের সংখ্যা তুলনায় নগণ্য, জনতার ভিড়ের নিরিখেও হয়তো তিন তারিখ উনিশ তারিখের সহিত পাল্লা দিতে পারিবে না। তবু তিন তারিখও উপচাইয়া পড়া ভিড় দেখিয়াছে। সেই ভিড়ের উৎসাহ উদ্দীপনার বহর দেখিয়া কে বলিবে যে অদূর অতীতেই এই দলটির রাজনৈতিক অস্তিত্ব লইয়া প্রশ্ন উঠিবার উপক্রম হইয়াছিল। ঘটনা হইল, সেই দিনের বাম সমাবেশ প্রমাণ করিয়া দিল যে বহু মানুষের আবেগ এখনও তাঁহাদের সহিত আছে। সেই আবেগ শেষ পর্যন্ত ভোটযুদ্ধাঙ্গনে সমর্থনে পরিণত হইবে কি না, ইত্যাদি কূট প্রশ্ন আপাতত সরাইয়া রাখিয়া বরং একটি অন্য বিষয়ে মনোযোগ করা দরকার। গণতন্ত্রে যে শাসক দলের সহিত বিরোধী দলের ভূমিকা ও পরিসরটিও অত্যন্ত জরুরি, বিরোধীহীন ময়দানে শাসক দলের একপাক্ষিক শাসনতন্ত্র যে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়, তিন তারিখের ব্রিগেড এই জরুরি কথাটি স্মরণ করাইয়া দিল। একটি বিরোধী দল আয়োজিত সমাবেশের সাফল্য পশ্চিমবঙ্গে একটি আশার শিখা জ্বালাইয়া গেল। শিখাটির জন্য কেবল বিরোধী সিপিএম নহে, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও কৃতিত্ব দাবি করিতে পারে। বাধাহীন ভাবে যে বিরোধী দলকে একটি সফল ব্রিগেড সমাবেশ করিতে দেওয়া গেল, এই দুর্দিনে ইহা বেশ দামি কথা।

Advertisement

কথাটি আরও দামি এই জন্য যে, গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র করিয়া তুলিবার জন্য শাসক দলের দায়ই সর্বাধিক। অথচ এই রাজ্যে গত কয়েক দশকে শাসক দলগুলি নিয়মিত ভাবে এই দায়টি বিস্মৃত হইয়াছে, বিরোধীকে সর্বাংশে দমন করিতে উদ্যত হইয়াছে। এই মারাত্মক অসহিষ্ণুতা বামফ্রন্ট আমলে রাজ্য জুড়িয়া দেখা গিয়াছে। বামফ্রন্টে শাসনের শেষ ভাগে এই অপরাধের জন্য তাহাদের বিস্তর মূল্যও চুকাইতে হইয়াছে। তাহাদের সেই অসহিষ্ণুতার যোগ্য উত্তরসূরি হইয়া উঠিয়াছে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১ সালের পর হইতেই সংশয় হইয়াছে, একটি বিরোধীহীন রাজ্য তৈরিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রধান লক্ষ্য। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনকে এই লক্ষ্যের সর্বোচ্চ বিন্দু বলিয়া মনে করা যায়, যখন রাজ্যব্যাপী প্রায় সব আসনেই বিরোধীহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইল। এই স্পর্ধার মূল্য তাহাদেরও এক দিন চুকাইতে হইবে, যদি না সদ্যোজাত শিখাটিকে সযত্নে রক্ষা করা যায়।

সত্যই যদি শিখাটিকে বাঁচাইয়া আলোকবর্তিকায় পরিণত করিতে হয়— বিরোধীদের দায়িত্বও তাহাতে কম নহে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক কর্মী-সমর্থকদের বার্তা দিয়াছেন যে সাহস করিয়া এই বার তাঁহাদের গ্রামে গ্রামে যাইতে হইবে, রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে। এই সৎসাহসের প্রয়োজন বুঝিতে কেন এত দিন লাগিল, প্রশ্ন উঠিতে পারে। ক্ষমতায় থাকিলে মানুষের সবটুকু পরিসর গ্রাস করিব, আর ক্ষমতায় না থাকিলে মানুষের পাশে গিয়া দাঁড়াইতেও পারিব না— এই রাজনীতিবোধ লইয়া সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের দিকে কেন, গণতান্ত্রিক আদর্শের দিকেও এগোনো যায় না। দুইটি সমাবেশ ঘটাইয়াই যেন এই রাজনৈতিক সুস্থতার শিখাটি নিবিয়া না যায়— ইহাই এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রার্থনা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement