আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল কুইন্সে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় আতঙ্ক ছড়াইয়াছে। কুইন্স ও তাহার সংলগ্ন ও নিকটস্থ এলাকাগুলিতে অগণিত এশীয় ও হিস্পানিক মানুষের বাস, তাঁহাদের একটি বড় অংশ নিউ ইয়র্ক শহরে শ্রমিক, ট্যাক্সিচালক, রেস্তরাঁকর্মী বা সাফাইকর্মী হিসাবে কর্মরত। তাঁহাদের আর্থিক অবস্থা সন্তোষজনক নহে, নিউ ইয়র্কের মতো ব্যয়বহুল শহরের এক কোণে কয়েক বর্গকিলোমিটার জায়গায় কোনও মতে ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া থাকেন। পেশাগত কারণে সামাজিক এবং পরিবেশগত কারণে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখিতে অসমর্থ এই সকল মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯ ছড়াইবার শঙ্কা বেশি, সেই আশঙ্কাই সত্য হইয়াছে।
অতি ভয়ঙ্কর রোগের আতঙ্কও শমনীয়, কিন্তু এই মানুষগুলিকে নিমিত্ত করিয়া ছড়াইতেছে যে বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষের ভাইরাস, তাহা রুখিবে কে? অতিমারির সময়ে যেখানে মানবিকতার অতিমানবিক হইয়া উঠা কাঙ্ক্ষিত, সেখানে রাজত্ব করিতেছে করোনার সহিত বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীকে সমার্থক বলিয়া চালাইবার অশুদ্ধ বিভেদবোধ। সমীক্ষা দেখাইতেছে, নিউ ইয়র্কের বহু অধিবাসীর মনোভাব, শহরে এই রোগ ছড়াইবার কারণ কেবল এশীয়— বিশেষত চিনা— ও হিস্পানিক মানুষেরা। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন করোনাভাইরাসকে ‘চাইনিজ় ভাইরাস’ বলিয়া দাগাইয়া দেন, বিদ্বেষবিষ তো ছুটিবেই। চিন হইতে ভাইরাস ছড়াইয়াছে সত্য, কিন্তু সমগ্র চিনবাসী বা চিনা মার্কিন নাগরিক কিংবা চিনা-সদৃশ মুখাবয়বের অধিকারী মাত্রেই করোনার জন্য দায়ী, এই অতিসরলীকরণ নিতান্ত মূর্খামি ও তদুপরি অসংবেদনশীলতার পরিচায়ক। অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার প্রধানও সকল সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে সতর্ক করিয়া দিয়াছেন, ভাইরাসের কারণে বর্ণ বা জাতিবিদ্বেষ না বাড়িয়া যায়, খেয়াল রাখিতে হইবে। কিন্তু শুনিতেছে কে! বিশ্ব জুড়িয়া চলিয়াছে চিনা-বিদ্বেষের স্রোত। মঙ্গোলয়েড মুখাবয়বের অধিকারী যে কেহই হেনস্থার শিকার হইতেছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির বহু নাগরিক আক্রান্ত হইয়াছেন দিল্লি হইতে মুম্বইয়ে। ইহাই শেষ নহে, তবলিগি জামাতের সূত্রে করোনার আবহে আবারও মাথাচাড়া দিয়াছে মুসলমান-বিদ্বেষ। উত্তরপ্রদেশে কোয়রান্টিনে থাকাকালীন দুই ব্যক্তি খোদ মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানের নিজ হস্তে রান্না করা খাবার খাইতে অস্বীকার করিয়াছেন, কারণ তিনি দলিত।
আরও পড়ুন: বৃদ্ধির হারকেই রাজনীতি মোক্ষ মেনেছে, তাই এই বিপদ
বিশ্বে যখনই কোনও বৃহৎ বা ভয়ঙ্কর ঘটনার বৈশ্বিক বা স্থানিক অভিঘাত মানুষকে প্রভাবিত করে, সেই মুহূর্ত হইতেই কোনও জাতিগত ‘অপর’-এর সহিত সেই ঘটনা বা অঘটনটিকে জুড়িয়া দেওয়া দেশে দেশে সংখ্যাগুরু বা ক্ষমতাবানের কাজ হইয়া দাঁড়ায়। আমেরিকা বা ভারতের ন্যায় বহুবিধ জাতি-গোষ্ঠীর সমাজে তাই চেহারা, পোশাক, ভাষা বা বাচনভঙ্গির ভিন্নতাও নিরপরাধ কিছু মানুষকে জনতার কাঠগড়ায় তুলিয়া দেয়। মানুষে মানুষে উচ্চ-নীচ ভিন্নতার বোধ যে কী রূপ অসার ও অর্থহীন, করোনাভাইরাস তাহা প্রমাণ করিয়া দিয়াছে। সকলেই তাহার প্রকোপে সমান পর্যুদস্ত। এহেন পরিস্থিতিতেও যে মানুষের চোখে শুধু সহমানুষের ভিন্নতাই সকল অনর্থের মূল বলিয়া ফুটিয়া উঠে, তাহার অন্ধতারও ক্ষমা নাই।
আরও পড়ুন: পণ্য চলাচল না বাড়লে সঙ্কট কিন্তু খুবই জটিল হয়ে উঠবে