ভারত কিসে আলাদা, যে হঠাৎ এতগুলো মানুষকে কাজের শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হল?
লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পরে ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে ভারতের রাস্তায় পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপুল স্রোত দেখে বিস্মিত হয়েছিল সকলে। কী ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁদের, সে কারও অজানা নয়। তা নিয়ে যে শোরগোল ওঠে, তার জন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের সহায়তার কিছু ব্যবস্থাও হয়। কিছু রাষ্ট্রের তরফে, কিছু জনসমাজের উদ্যোগে। কিন্তু একটা ধাঁধা থেকেই যাচ্ছে। বিশ্বের বহু দেশে কোভিড-১৯ অতিমারি ভারতের চাইতে আরও বড় আকারে দেখা দিয়েছে। কিন্তু সে সব দেশে এ ভাবে রাস্তায় মজুরদের ঢল নামার খবর আমি অন্তত কোথাও দেখিনি। ভারত কিসে আলাদা, যে হঠাৎ এতগুলো মানুষকে কাজের শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হল?
অতীতে ভারতের শহরগুলো বিপুলসংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। দেশভাগের জন্য উদ্বাস্তুরা, কিংবা কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষ যে কোনও ফাঁকা জমিতে বসে গিয়েছেন। মুম্বইয়ের ধারাভি, বা কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে যাঁরা বাস শুরু করেছিলেন, দুই-তিন প্রজন্মের পরে তাঁদের উত্তরপুরুষরা আজ সেই সব শহরের বৈধ নাগরিক। তা হলে আজ এত আতঙ্ক কিসের? নাগরিক জীবনযাত্রা সচল রাখতে যাঁদের অবদান স্বীকৃত, তাঁদের নাগরিক স্বীকৃতি পেতে বাধা কোথায়?
এ বার লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন দু’ধরনের কর্মী। এক, যাঁরা সারা বছর কাজে নিযুক্ত থাকেন, কিন্তু বৈধ চুক্তি কিছু নেই। যেমন পশ্চিমবঙ্গের সোনার কারিগররা কাজ করেন গুজরাত ও মহারাষ্ট্রে, বাঙালি মেয়েরা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন গুরুগ্রামে। বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও পরিষেবায় এঁরা কাজ করেন, কেউ আসেন বহু দূরের রাজ্য থেকে, কেউ আশেপাশের গ্রাম থেকে। একই গ্রামের লোকেরা, বা একই কাজে নিয়োজিত লোকেরা অনেকে একত্র বাস করেন। এই শ্রমিকদের বৈধ নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় না, ছেলেমেয়েদেরও ওই শহরের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি মেলে না। এই দলের মধ্যেই পড়েন সেই কর্মীরা, যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করে কাজ করেন। লকডাউনে পরিবহণের অভাবে আতান্তরে পড়েছেন তাঁরাও।
আরও পড়ুন: অন্ধকারের ভেতর থেকে দেখা দিচ্ছে ‘অসম্পূর্ণ কদাকার জলহস্তী সব’
আরও পড়ুন: নৈতিকতাহীন শাসককে কী বলতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ বা গাঁধী
অন্য দলটি হল প্রধানত সেই গ্রামবাসীদের, যাঁরা চাষের কাজের পরে বাড়তি রোজগারের আশায় কয়েক মাসের জন্য অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ অঞ্চলে কাজ করতে যান। দুর্ভাগ্য, এখন এমন মানুষরাও পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাচ্ছেন।
পরিযায়ীদের ঘরে ফেরার জন্য আতঙ্কিত হয়ে পড়ার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে আরও এক রহস্যের— উন্নয়নের হারে ভারতের কাছাকাছি যে সব দেশ, তাদের তুলনায় ভারত নগরায়ণের হার অনেক কম। ২০১৭ সালে প্রণব সেন একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, এর কারণ ভারতে রাজনৈতিক নেতাদের চোখের সামনে বরাবরই ভারতের যে দৃশ্য ভাসে, তাতে অনেক সাবেক গাঁধীপন্থী গ্রাম রয়েছে গোটাকতক নেহরুপন্থী আধুনিক শহরের পাশাপাশি। এই ব্যাখ্যা আগ্রহ জাগায়, কিন্তু এতেই সবটা বোঝা যাচ্ছে না।
আরও দু’টি শক্তিশালী বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, লাটিয়েন্সের দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী, এবং পরে সল্টলেক পর্যন্ত ভারতে নগরায়ণের পরিকল্পনা যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা মধ্যবিত্তের অণু-পরিবারের জন্য বাড়ি তৈরির কথা ভেবেছিলেন, শ্রমিকদের বাসস্থান জোগানোর কথা ভাবেননি। কলকাতায় যখন সল্টলেকের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হচ্ছে, তখন সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত আমরা কয়েক জন প্রশ্ন করেছিলাম— দরিদ্র, শ্রমজীবীদের জন্য কোনও জায়গাই তো নির্দিষ্ট করা হচ্ছে না। তাঁদের কী হবে? ষাটের দশকের শেষের দিকে নগরলোক পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে আমি বলেছিলাম, কল্যাণী যে কলকাতার বিকল্প হতে পারেনি তার প্রধান কারণ, কল্যাণীর পরিকল্পনায় এই ত্রুটি। এমন ত্রুটি সত্ত্বেও দিল্লি ও সল্টলেক দ্রুত বেড়েছে, তবে তা প্রধানত এই কারণে যে নানা ধরনের সরকারি দফতর ও কাজ-কারবার চালু হয়ে গেল এ সব জায়গায়। এবং এই সব শহরে আজও দরিদ্র মজুরেরা অবৈধ বাসিন্দা হয়ে রয়ে গিয়েছেন।
স্থানাভাব ছাড়া আরও বড় একটি বাধা হল রাজনৈতিক নেতা আর তাঁদের দালালরা। সত্তরের দশক থেকেই কাজের চাহিদার সঙ্গে কাজের জোগান পাল্লা দিতে পারছিল না। সব রাজনৈতিক দল তখন একটা কৌশল নিল— তৈরি করল বাহুবলী অনুগতদের বাহিনী, যারা কর্মহীন মানুষদের নেতা হয়ে উঠল। নানা অবৈধ সুযোগ দিয়ে তাঁদের জীবিকানির্বাহের উপায় করে দেওয়া হল, যেমন ফুটপাতে দোকান দেওয়া, লরি পার্কিং করা, ইত্যাদি। তার বদলে রাজনীতির দাদাদের নিয়মিত টাকা দিতে হত। নেতারাও ভাগ পেত, আর সেই সঙ্গে দাদাদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা লোকেদের ভোট পাওয়ার নিশ্চয়তা পেত, আর বিনিময়ে পুলিশি সুরক্ষা দিত দাদাদের।
এমন তোলা আদায়ের উপায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক হল বাড়ি তৈরি। নির্মাণ-নীতি এবং পরিবেশ সুরক্ষা-বিধিকে অগ্রাহ্য করে বড় বড় আবাসন প্রকল্প তৈরি করা শুরু করেছিলেন প্রভাবশালী নির্মাতা তথা নেতারা। মুম্বই এবং কলকাতায় এমন অনেক উদাহরণ আমাদের জানা আছে। নানা স্তরে সেই নকশা ধরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এলাকার দাদারা। এখন শহরের সমস্ত জমি আর আবাসন তাদের দখলে। মধ্যবিত্ত সারা জীবনের সঞ্চয়ের বিনিময়ে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর হেলাফেলায় তৈরি ফ্ল্যাট পেয়েছে। নগর-পরিকল্পনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুকুর বুজিয়ে বাড়ি উঠছে। দরিদ্র মজুররা আধা-তৈরি কাঁচা বাড়িতে, নাগরিক সুবিধাহীন জলাজমি এলাকায় স্থান পেয়েছেন। শহরে নবাগতরা সকলেই বাধ্য হন এই জঘন্য বাসস্থান ব্যবস্থা মেনে নিতে এবং এলাকার দাদাদের অতি উচ্চ হারে ভাড়া দিতে। ক্রমে রেল, ডক প্রভৃতি সমস্ত সরকারি জমি চলে গিয়েছে ‘ডেভলপার’-দের হাতে। ভারতে খুব কম শহরই অল্প ভাড়ায় শ্রমিক আবাসনের জন্য জমি দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ তো কিছুই দেয়নি। দরিদ্র শ্রমজীবীদের একমাত্র উপায় গ্রামে বাস করা এবং অসীম ঝঞ্ঝাট সহ্য করে নিয়মিত শহরে যাতায়াত করা। প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ নাকি রোজ কলকাতায় যাওয়া-আসা করেন।
এই সমস্যার নিদর্শন মেলে ইতিহাসেও। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ব্রিটেনে প্রচুর শ্রমিক আসেন দক্ষিণ এশিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ় থেকে (তখন প্রাক্তন উপনিবেশের নাগরিকদের ভিসা লাগত না)। সে সময়ে ব্রিটেনে মজুরের অভাব, তাই সকলেই কিছু না কিছু কাজ পেয়ে যেতেন, যতই খারাপ হোক। কিন্তু বিশ্রী বস্তিবাড়িতে থাকার জন্য চড়া ভাড়া দিতে হত। রচম্যান নামে এক বর্ণবিদ্বেষী মালিকের নামে এমন গলায় পা-দিয়ে ভাড়া আদায়ের প্রথার নামই হয়ে গেল ‘রচম্যানিজ়ম’। এমন শোষণ নিয়ে প্রবল জনরোষের মুখে পড়ে স্থানীয় সরকারগুলো। শেষ অবধি ব্যাপক হারে সুলভ আবাসন (কাউন্সিল হাউজ়িং) নির্মাণ শুরু করে, যা সস্তা দরে কিনতে বা ভাড়া নিতে পারতেন নিম্নবিত্ত শহুরে শ্রমিকরা।
আমরা যারা শহরের বৈধ নাগরিক, তাদের কাছে গরিবের আবাসন-বঞ্চনার কটু সত্য ফের উন্মুক্ত করল অতিমারি। দুঃখের বিষয়, এই অতিমারিও বাহুবলী নেতাদের ক্ষমতা কমাতে পারেনি। রাজনীতির প্রশ্রয়ে পুষ্ট দাদাদের চড়া বাড়িভাড়ার খাঁই মেটানো অসাধ্য হয়ে পড়লে পরিযায়ী শ্রমিকদের আর কী উপায় ছিল, রাস্তায় নামা ছাড়া? প্রাণ হাতে নিয়ে তাঁরা বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন, কারণ নিজের বাড়ি থেকে অন্তত কেউ বার করে দিতে পারবে না।