মোদীর সামনে মহানায়ক থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠার সুযোগ
Coronavirus

রাজনীতির কুনাট্য চলছেই

দিদিভাইয়ের মতো মোদীভাইয়ের ভক্তরাও তাঁকে ‘রাষ্ট্রপিতা’ না হোক, অন্তত ‘রাষ্ট্রনায়ক’-এর ভূমিকায় দেখতে চান।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২০ ০০:১১
Share:

ছবিটা এত দিনে অনেকের মোবাইলেই পৌঁছেছে। বাংলার মানচিত্রের চার পাশে চক দিয়ে নিজের হাতে বৃত্ত এঁকে দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মুখে মাস্ক। ওই বৃত্তটা যেন লক্ষ্মণরেখা। করোনাভাইরাস নামক রাবণকে ঠেকাতে রাজ্যের চারপাশে গণ্ডি।

Advertisement

তাঁর অনুগামীরা বলছেন, করোনাভাইরাস-কাণ্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের ‘দিদি’ থেকে ক্রমশ ‘মা’ হয়ে উঠছেন। মুখ্যমন্ত্রী থেকে তাঁর ক্রমশ রাজ্যের অভিভাবিকার ভূমিকায় উত্তরণ ঘটছে।

দিদিভাইয়ের মতো মোদীভাইয়ের ভক্তরাও তাঁকে ‘রাষ্ট্রপিতা’ না হোক, অন্তত ‘রাষ্ট্রনায়ক’-এর ভূমিকায় দেখতে চান। লকডাউন ঘোষণার আগের রবিবার বিকেল পাঁচটায় গোটা দেশ এক হয়ে থালা-ঘণ্টা বাজানোর পরে বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেছিলেন, দেশের এমনই এক ‘মহানায়ক’-এর প্রয়োজন ছিল, যাঁর ডাকে গোটা দেশ সব মতভেদ ভুলে একসঙ্গে উঠে দাঁড়াবে।

Advertisement

নিন্দুকেরা বলেন, আসলে শুধু নরেন্দ্র মোদীর ভক্তরা নন, নরেন্দ্র মোদী নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় দেখতে চান। তাই তিনি মহানায়কের মতোই নিজের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি ঠোকেন। গুজরাতে সর্দার বল্লভভাই পটেলের আকাশছোঁয়া মূর্তি তৈরি যতখানি না সর্দারকে অমর করে রাখার জন্য, তার থেকেও বেশি নিজের স্বাক্ষর রেখে দেওয়ার জন্য। একই অমরত্বের প্রত্যাশায় তিনি রাজধানী দিল্লিকে নতুন করে গড়ে তুলতে চান। নতুন সংসদ ভবন, নতুন সচিবালয়। রাইসিনা হিলস থেকে ইন্ডিয়া গেট—রাজপথের দু’পাশে সব ভেঙে নতুন করে গড়তে চান তিনি। ভাবীকাল বলবে, সবটাই নরেন্দ্র মোদীর তৈরি। সমালোচকরা বলেন, এই অমরত্বের প্রত্যাশাতেই প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর ভাঙা-গড়ার কাজে ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। আর মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে।

নিন্দুক-সমালোচকদের কথা থাক। দেশের রাজধানীর রাজনীতিতে এখন বেশ অন্য রকম আবহ। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন, করোনভাইরাসের মোকাবিলায় কংগ্রেস সরকারের পাশে রয়েছে। রাহুল গাঁধী ফেব্রুয়ারির মাঝমাঝিই করোনাভাইরাস সম্পর্কে মোদী সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। সরকার তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত। রাহুলের ক্ষোভ, তিনি বার বার বলেও সরকারের টনক নড়াতে পারেননি। এখন তিনি মোদী সরকারের কড়া সমালোচনা করতে চান। কিন্তু প্রবীণ ব্রিগেড তাতে রাজি নন। তাঁরা এই মুহূর্তে রাজনীতির চাপানউতোরের ঊর্ধ্বে উঠতে চান। বা অন্তত তেমনটাই দেখাতে চান। বামপন্থীরা বাদে বাকিদের মুখেও এখন রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অতিমারির মোকাবিলার কথা।

মুখে যে যা-ই বলুন, করোনাভাইরাস ও তার মোকাবিলার এক বিন্দুও আসলে রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। আসলে সময়ের দলিলে সবটাই তোলা থাকবে। দেশ জুড়ে অতিমারির মোকাবিলায় কে সফল, কে ব্যর্থ, তার সবটাই রাজনীতির দাঁড়িপাল্লায় মাপা হবে।

এখানেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চ্যালেঞ্জ। তিনি যে এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজনীতিক, তা তাঁর নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই। কিন্তু ছয় বছর প্রধানমন্ত্রীর গদিতে থাকার পরে করোনাভাইরাস বোধ হয় তাঁর সামনে একই সঙ্গে কঠিন চ্যালেঞ্জ এবং নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের হাত থেকে দেশকে আগলাতে পারলে তাঁর রাষ্ট্রনায়ক বা রাষ্ট্রের অভিভাবকের ভূমিকায় উত্তরণ ঘটবে। আর ব্যর্থ হলে? দেশের মানুষের ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’-এর মোহ কেটে যাবে।

এই ময়দানে নরেন্দ্রভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী নরেন্দ্রভাই নিজেই।

মুশকিল হল, রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার সঙ্গে প্রশাসনিক দক্ষতার কোনও সম্পর্ক নেই। যেমন, সাহসী সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা থাকলেই যে সেই সিদ্ধান্ত রূপায়ণের পরিকল্পনাটি নিখুঁত হবে, তারও অর্থ নেই। মোদী জমানার ছয় বছরে এই বিষয়টি তিন বার প্রমাণিত হল। ইউপিএ অনেক চেষ্টা করেও যে জিএসটি চালু করতে পারেনি, মোদী সরকার সেই জিএসটি চালু করে বড় পদক্ষেপ করেছিল। কিন্তু সেই জিএসটি ব্যবস্থায় এতই খুঁত থেকে গিয়েছিল যে এখনও তা মেরামত করা যায়নি। নরেন্দ্র মোদীর নোট-বাতিলের ঘোষণাও এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নোট-বাতিলের মতো চমকের লাভ-লোকসান কী হয়েছে, সে বিতর্ক থাক। কিন্তু নোট-বাতিলের ঘোষণার সঙ্গে যে আনুষঙ্গিক পরিকল্পনা ছিল না, তা নিয়ে কারও সংশয় নেই।

এ বার ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণার পরেও আগাম পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। দিনমজুর, পরিযায়ী শ্রমিকদের কী হাল হবে, সরকার ভাবেনি। ভাবলে লাখে লাখে শ্রমিক খালি পেটে, মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটতে শুরু করতেন না। ডাক্তার-নার্সদের জন্য প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশকে থালা বাজাতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁদের জন্য মাস্ক, শরীর ঢাকা পোশাক, রোগীর ভেন্টিলেটর, টেস্টিং কিটের পর্যাপ্ত বন্দোবস্ত তাঁর সরকার করে উঠতে পারেনি। নিছক পরিকল্পনার অভাব।

মানুষ অবশ্য সবই ভুলে যাবে। অতিমারি থেকে দেশকে মোটের উপর রক্ষা করতে পারলেই মানুষ ভুলে যাবে, ৩০ জানুয়ারি ভারতে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়লেও গোটা ফেব্রুয়ারি মাসটাই সরকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভ্যর্থনায় ব্যস্ত ছিল। এমনকি ১৩ মার্চও সরকার দাবি করেছে, করোনা কোনও ‘হেল্থ এমার্জেন্সি’ নয়। বিজেপি নেতারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মধ্যপ্রদেশে কমলনাথ সরকারের গদি ওল্টাতে। ভোটাভুটি এড়াতে কংগ্রেস করোনা-সংক্রমণের ভয় দেখিয়ে মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার অধিবেশন মুলতুবি করে দিয়েছিল। তা ভুল প্রমাণ করতেই করোনা-সংক্রমণের বিপদ অগ্রাহ্য করে সংসদের অধিবেশন চলেছে।

আরও সুবিধা হল, করোনাভাইরাসের জেরে আপাতত অন্য সব প্রশ্নই শিকেয় উঠেছে। সিএএ-এনপিআর-এনআরসি এই ক’দিনেই বহু যুগ আগের বিষয় মনে হচ্ছে। দিল্লির সংঘর্ষের জন্য কে দায়ী, কে নয়, তা-ও অতীত। করোনাভাইরাসের জেরে গোটা দুনিয়ার মতো ভারতের অর্থনীতিও যে বড় রকমের ধাক্কা খেতে চলেছে, তা স্পষ্ট। কিন্তু তার আগেও যে অর্থনীতি ঝিমিয়ে ঝিমিয়েই চলছিল, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে দিশেহারা বোধ করছিলেন, মানুষের স্মৃতি থেকে ক্রমশ তা মুছে যাচ্ছে। এর পরে অর্থনীতির হাল যতই খারাপ হোক, তার জন্য মোদী সরকারকে কেউ দুষতে পারবেন না। দুষলেও সরকারের পক্ষে জোরালো যুক্তি থাকবে, গোটা দুনিয়ার হালই খারাপ হলে ভারতের ছবিটা আলাদা হবে কী করে? অতিমারির জেরে বিশ্ব জুড়ে মন্দা এলে মোদীই বা একা কী করে এ দেশের অর্থনীতিকে আগলে রাখবেন?

অকাট্য যুক্তি। অর্থনীতির বদলে প্রধানমন্ত্রী এখন মানুষের প্রাণ বাঁচানোকেই প্রধান সঙ্কল্প করেছেন। জান হ্যায় তো জাঁহান হ্যায়। এক দিন রাত আটটায় তিনি ঘরে থাকার উপদেশ দিচ্ছেন। বিজয়বর্গীয়রা বলছেন, ঠিক পরিবারের মুখিয়ার মতো। আর এক দিন সকালে তাঁর মন কি বাত-এ লকডাউনের জেরে সব রকম অসুবিধার জন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছেন। পরিবারের সকলের দিকে খেয়াল রাখা যত্নশীল অভিভাবকের মতো।

দেশের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, সমব্যথী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীকে তুলে ধরতেই কি অমিত শাহ এখন কার্যত অদৃশ্য? তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকই লকডাউনের দায়িত্বে। লকডাউনের সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যাতে অভাব না হয়, রাজ্যগুলির সঙ্গে মিলে তা দেখার দায়িত্বেও অমিত শাহর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। দ্বিতীয় মোদী সরকারের দশ মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ৩৭০ ধারা রদ, সিএএ-এনআরসি বা দিল্লির হিংসা নিয়ে শাহর আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক চেহারাটাই সরকারের মুখ হয়ে উঠছিল। এখন ফের মোদীই মুখ। মুখে আশ্বাসবাণী। তাঁর কথা শুনে ঘর-বন্দি থাকলে তিনি এ বিপদ পার করিয়ে দেবেন বলে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা।

‘মহানায়ক’ থেকে ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হয়ে উঠতে ঠিক যেমনটি দরকার।

অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement