গত শুক্রবার অপরাহ্ণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিলেন: অনেক হইয়াছে, আর নয়। রাজ্যের, বিশেষত কলিকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলের কিছু এলাকায় কোভিড-১৯’এর প্রকোপে তিনি উদ্বিগ্ন। নাগরিকদের অনেকেরই লকডাউনের বিধান না মানিয়া যথেচ্ছ মেলামেশার বিপজ্জনক প্রবণতায় তিনি ক্ষুব্ধ। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সতর্কবাণী: আর নহে, এই বার কঠোর অনুশাসন পর্ব, প্রয়োজনে সশস্ত্র পুলিশও রাস্তায় নামিবে। তাঁহার এই ক্ষোভ স্বাভাবিক। ভারতে নোভেল করোনাভাইরাসের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ অনেক দিন অবধি যেখানে ছিল, গত প্রায় এক সপ্তাহে রাজ্যের পরিস্থিতি তাহার তুলনায় বেশ কিছুটা খারাপ হইয়াছে। এই অবনতি রাজ্যের সামগ্রিক চিত্র নহে। বস্তুত পূর্ব মেদিনীপুরের মতো দৃষ্টান্তও রহিয়াছে যেখানে প্রাথমিক উদ্বেগের পরে সংক্রমণের চমকপ্রদ নিয়ন্ত্রণ ঘটিয়াছে। কিন্তু কয়েকটি অঞ্চলে ভাইরাসের দাপট বাড়িতেছে। এই এলাকাগুলিতে সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশেষ তৎপরতা অত্যাবশ্যক, নচেৎ বিপদ দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইতে পারে, তখন বিপন্ন এলাকার পরিধিও দ্রুত প্রসারিত হইতে পারে। একই কারণে, আপাতত ‘নিরাপদ’ এলাকাগুলিতেও সতর্কতা কোনও অংশে কম জরুরি নহে। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজে সতর্কতার বোধ যথেষ্ট নহে, এই সংক্রমণের পর্বেও তাহার বিস্তর প্রমাণ অহরহ মিলিতেছে— বহু অঞ্চলে বহু মানুষ, আপাতবিচারে ‘শিক্ষিত’ মানুষও সম্পূর্ণ অকারণে সামাজিক দূরত্ব ভাঙিবার ঝুঁকি লইয়া চলিয়াছেন। সমগ্র রাজ্যেই ‘কড়া দাওয়াই’য়ের কথা ভাবিলেই মঙ্গল। প্রশাসনের বাড়তি তৎপরতা অবশ্যই জরুরি।
তৎপরতা বৃদ্ধির অন্য একটি দিকেও কিঞ্চিৎ ভরসা মিলিয়াছে গত সপ্তাহের শেষে। রাজ্য সরকারের মুখ্য সচিব জানাইয়াছেন, নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরিবার জন্য নমুনা পরীক্ষার (টেস্টিং) গতি আগামী সপ্তাহে বাড়িতে পারে। জোর কদমে চালু হইতে পারে বিশেষ দ্রুত-পরীক্ষাও (র্যাপিড টেস্টিং)। পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ইহা কেবল সুসংবাদ নহে, জরুরি সংবাদ। গোটা দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে এই ভাইরাস পরীক্ষার মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গের স্থান নীচের সারিতে। অথচ যথেষ্ট পরীক্ষা করিয়া চলাই এই সংক্রমণের সঙ্গে লড়াইয়ে একটি বড় অস্ত্র। দক্ষিণ কোরিয়া বা ভিয়েতনামের মতো দেশ হইতে শুরু করিয়া কেরলের মতো রাজ্য— প্রতিটি ক্ষেত্রে এই অস্ত্রের সাফল্য ইতিমধ্যে প্রমাণিত এবং বহুচর্চিত। করোনা-যুদ্ধে অন্যান্য অস্ত্রও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন যথেষ্ট রক্ষাকবচ, সংক্রমিত ব্যক্তিকে সুরক্ষিত ও আরক্ষিত রাখিবার যথেষ্ট আয়োজন, ইত্যাদি। পরীক্ষাই যথেষ্ট, এমন কথা কেহ বলিতেছেন না; কিন্তু পরীক্ষা জরুরি।
মুখ্য সচিবের কথায় আশা করিবার কারণ আছে যে, পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এখন নাগালে রহিয়াছে, যাঁহারা পরীক্ষা করিবেন তাঁহাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও অগ্রসর হইয়াছে, অন্যান্য পরিকাঠামোও প্রস্তুত হইতেছে, এই বার পরীক্ষায় বেগ আসিবে। না-হওয়া অপেক্ষা দেরিতে হওয়া শ্রেয়। আশা, রাজ্যে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রটি অচিরে আরও স্পষ্ট হইবে, পরিসংখ্যান, আরও নির্ভরযোগ্য। ভাইরাসের মোকাবিলায় এই স্পষ্টতা ও নির্ভরযোগ্যতা অপরিহার্য। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার প্রশাসনের সদিচ্ছা লইয়া প্রশ্ন নাই। তাঁহার ব্যক্তিগত ভূমিকা, সেই ভূমিকায় নিহিত আন্তরিকতা এবং সাহস, তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ পরিশ্রম— সকলই সর্বজনবিদিত এবং বহুজনস্বীকৃত। সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রটি বিশদ ভাবে জানা থাকিলে সেই পরিশ্রম এবং আন্তরিকতার সুফল অনেক বেশি মিলিবে। তাহার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ শুরু হউক। পরীক্ষা কেন কম— এই অভিযোগ লইয়া সওয়াল-জবাব অনেক হইয়াছে। আর নহে।
আরও পড়ুন: এক মৃত্যুর আড়ালে অন্য মৃত্যু