সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গেই বেশ কিছু রাজ্য সরকার শ্রমিক সুরক্ষা আইন সংশোধনে মত দিয়েছে, ফলে শিল্পবিরোধের নিষ্পত্তি থেকে কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রাপ্তি, সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
কলকারখানা খুলছে বটে, কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, যদি সংস্থার পরিচালকমণ্ডলীর সম্মতি, অবগতি বা অবহেলায় কোনও কর্মী কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত হন, তবে ২০০৫ সালের বিপর্যয় মোকাবিলা আইন অনুযায়ী সংস্থার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অর্থাৎ সরকার চায় যে এক দিকে সংস্থাগুলি কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানবে ও করোনা সংক্রমণ এড়ানো যাবে; অন্য দিকে উৎপাদনের সঙ্গে বেশ কিছু মানুষের আয় ও পণ্য ও পরিষেবার জোগান বৃদ্ধি সম্ভব হবে।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণের ভয় না দেখিয়ে এমন কোনও বিকল্প ব্যবস্থা কি করা যেত না, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে? প্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে অনভিপ্রেত কিছু রোধ করার প্রচেষ্টার পরিবর্তে যদি ইনসেনটিভ বা প্রণোদনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া যায়, তা হলে হয়তো কোনও পদক্ষেপ আরও ইতিবাচক বা কার্যকরী হতে পারত। যেমন, একটি শিশুকে অঙ্ক না পারার শাস্তি ঘোষণা করার বদলে, অঙ্ক পারলে চকলেট দেওয়া হবে— এমন প্রতিশ্রুতি কিন্তু কার্যসিদ্ধির বেশি সহায়ক হতে পারে। সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গেই বেশ কিছু রাজ্য সরকার শ্রমিক সুরক্ষা আইন সংশোধনে মত দিয়েছে, ফলে শিল্পবিরোধের নিষ্পত্তি থেকে কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রাপ্তি, সব কিছুই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে সরকার নির্দেশিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে শিল্পক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
এই মুহূর্তে সমগ্র দেশ থেকে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে এই সংক্রমণের রেশ দীর্ঘকালীন হতে চলেছে। সুতরাং সংক্রমণের ভয়ে অনেক সংস্থাই কর্মীদের গৃহবন্দি থেকে কাজের নির্দেশ দিতে পারে বা সরাসরি যন্ত্রীকরণ বা মেকানাইজ়েশনের দিকে ঝুঁকতে পারে। এমনকি, স্বল্প আয়ের কারণে স্বল্প চাহিদা, এবং শাস্তির ভয়ে উৎপাদনে উৎসাহও হারাতে পারে। এর মধ্যেই ছয়টি ভোগ্যপণ্য নির্মাতা সংস্থা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্পসংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ করেই অধিক উৎপাদন করা যায়। পরিযায়ী শ্রমিকরা গ্রামে ফিরে যাওয়ায় এমনিতেই কর্মীর অভাব। ফলে সংস্থাগুলি তাদের উৎপাদন ক্ষমতার ৬০-৬৫ শতাংশের বেশি ব্যবহারই করতে পারছে না। এই অবস্থায় সরকারি নীতি যদি তাদের আরও যন্ত্রীকরণের দিকে ঠেলে দেয়, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য।
আরও পড়ুন: আদৌ দূষণমুক্ত পরিবেশ থাকবে আন-লক পর্বে?
যন্ত্রীকরণ হয়তো উৎপাদন বৃদ্ধি বা ব্যয় হ্রাসে সক্ষম হবে। কিন্তু ভারতের মতো দেশে, প্রতিনিয়ত যেখানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার মানবিক মূলধন বা দক্ষ শ্রমিক ও অদক্ষ শ্রমিকের মধ্যে একটি কারিগরি বিভাজন সৃষ্টি করছে, সেখানে যন্ত্রীকরণ এই পর্যায়ে বেকারত্বের সমস্যাকে তীব্রতর করবে। এখনই বিভিন্ন সমীক্ষা সমগ্র বিশ্বে অসংখ্য মানুষের কাজ হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এই অবস্থায় সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে যন্ত্রীকরণ, না কি বেকারত্বের হারকে একটি নির্দিষ্ট স্তরে আটকে রাখা, কোনটি সংক্রমণের এই পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাবে।
শাস্তি ঘোষণা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিবর্তে সরকার যদি শিল্পকারখানায় জীবাণুনাশের জন্যে ভর্তুকি দেয়, সেটাই কিন্তু উদ্দীপক বা প্রণোদনার ভূমিকা নিতে পারে। ভর্তুকিপ্রাপ্ত সংস্থা যদি যথাযথ ভাবে জীবাণুনাশের ব্যবস্থা করে, তবে সংক্রমণের সম্ভাবনা হ্রাস পেয়ে সরকারের উদ্দেশ্যই সাধিত হবে। একই সঙ্গে কর্মীরা নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র পেলে উৎপাদন সম্ভবপর হবে। পর্যায়ক্রমে আয়, ভোগ বৃদ্ধি পেয়ে কার্যকরী চাহিদাও বাড়বে।
এই ভাবেই যে সব সংস্থা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখবে, সরকার তাদের বিভিন্ন সুবিধা দিতে পারে। যে সংস্থায় কর্মীরা নিরাপদ থাকছেন, তাদের যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক লাঘব করা যেতে পারে। শাস্তির জুজুর পরিবর্তে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার পুরস্কারস্বরূপ কর ছাড়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেতে পারে। সংস্থা যদি সংক্রমণ রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে, তাকে সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া যায়। শাস্তির আশঙ্কায় কোনও সংস্থা যদি অধিক মাত্রায় যন্ত্রীকরণের দিকে ঝোঁকে, তা হলে হয়তো সংক্রমণ প্রশমিত হবে, তবে একই সঙ্গে কর্মী-সঙ্কোচনও অনিবার্য। সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নন, এমন সহযোগী কর্মীর সংখ্যাও কমবে। তাই এই পরিস্থিতিতে শাস্তির ভয় না দেখিয়ে সরকার বিভিন্ন প্রণোদনার সাহায্য নিলে, সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
এই অপ্রত্যাশিত ও ভয়াবহ পরিস্থিতি আমাদের পরিযায়ী শ্রমিকদের অসহায়তা ও দুরবস্থাও প্রকট করল। যদি কর্মস্থলের আশেপাশে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান ও খাদ্যের বন্দোবস্ত থাকত, তবে মাইলের পর মাইল হেঁটে এদের ঘরে ফেরার প্রবণতা দেখা দিত না। সে ক্ষেত্রে সংক্রমণ আঞ্চলিক ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত হলেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করে এদের উপার্জন বাড়ত। চাহিদা ও উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাও থাকত।
অর্থনীতি বিভাগ, মহারাজা শ্রীশচন্দ্র কলেজ, কলকাতা