ভারত কম দেখেনি বিপন্ন মানুষের মিছিল। নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারের সমস্তটুকু পোঁটলায় বেঁধে, কোলে-কাঁখে বাচ্চা নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটছে অভুক্ত নরনারীর দল— এই দৃশ্যের স্মৃতি ভারতে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে। তার পরও, লকডাউন ঘোষণার পর দেশের হাইওয়ে ধরে শহর থেকে গ্রামের দিকে যে জনস্রোত হাঁটতে আরম্ভ করল, সেই জনস্রোত ভারত এর আগে কখনও দেখেনি। সংখ্যার হিসেবে এর চেয়ে অনেক বড় অভিবাসন দেখেছে, হয়তো বিপন্নতার মাপকাঠিতেও। কিন্তু, একটা মোক্ষম জায়গায় এই মিছিল সম্পূর্ণ নতুন।
এই মিছিল চলেছে উল্টো অভিমুখে— শহর থেকে গ্রামের দিকে। যে গ্রাম ছেড়ে তাঁরা শহরে গিয়েছিলেন যৎকিঞ্চিৎ ভাল থাকার আশায়। এর আগে যত যুথবদ্ধ অভিবাসন দেখেছে ভারত, সেগুলো গ্রাম ছেড়ে এসেছিল শহরের আশ্রয়ে। প্রাক্-ধনতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থা থেকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থায়— ভিত্তি থেকে ভবিষ্যতের দিকে। গোটা দুনিয়া জুড়েই তা-ই হয়েছে চির কাল, তেমনটাই দস্তুর। ধনতন্ত্রের দস্তুর। লকডাউনের ভারতে অভিবাসী শ্রমিকরা এই আবহমান স্রোতের বিপরীতে হাঁটলেন। পরশুর পরের দিন কোভিড-১৯’এর ভয় ফুরোলে তাঁদের অনেকেই ফিরে আসবেন শহরে, ফিরে যাবেন ছেড়ে যাওয়া কাজে। কিন্তু, তাতে এই কথাটা হারিয়ে যাবে না যে এই প্রথম সঙ্কটের মুহূর্তে আশ্রয়স্থল হল ছেড়ে আসা গ্রাম— সেই গ্রাম, মানুষ যাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল সেখানে সামান্য উন্নয়নের সুযোগটুকুও নেই বলে।
লেনিন লিখেছিলেন, ধনতন্ত্র হল অন্তহীন ভয়াবহতা— হরর উইদাউট এন্ড। গত দু’তিন সপ্তাহের ঘটনাক্রম দেখার পর কথাটার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন। প্রশ্ন হল, সেই ভয়াবহতা টের পাওয়ার জন্য কোভিড-১৯’এর অপেক্ষায় থাকতে হল কেন? মাস তিনেক আগে, জানুয়ারিতে, অক্সফ্যামের একটা গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, ভারতের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ রয়েছে মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে। আজ ক্ষুধার্ত মুখের মিছিল দেখে যে ভাবে টের পাচ্ছি ‘ধনতন্ত্রের অন্তহীন ভয়াবহতা’— সম্পদ বণ্টনের এই অবিশ্বাস্য অসাম্যের ছবি দেখে ঠিক সে ভাবেই কথাটা বুকে ধাক্কা দিয়েছিল, বললে মিথ্যে বলা হবে। অথচ, বণ্টনের সেই অসাম্যের সঙ্গে হাইওয়ে ধরে তিনশো কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফেরার মরিয়া বাঁচার লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ যোগ— এতখানি অসাম্য যদি না থাকত, আর্থিক বৃদ্ধির একটু বেশি ভাগ যদি এই মানুষগুলো পেতেন, অতিমারি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের বেঁচে থাকা এতখানি অনিশ্চিত হয়ে পড়ত না। কয়েকটা দিন সামাল দেওয়ার টাকাটুকু অন্তত তাঁদের হাতে থাকত।
আরও পড়ুন: এই আমাদের দুর্ভাগা দেশ
সেই অশালীন অসাম্যে আমরা পুঁজিবাদের অন্তহীন ভয়াবহতা দেখতে পাইনি কেন, এই প্রশ্নের উত্তর আদ্যন্ত রাজনৈতিক। অর্থনীতিকে কোন মাপকাঠিতে মাপা হবে, তা স্থির করার রাজনীতি। খেয়াল করে দেখুন, গত দশ-পনেরো বছরে যখন ভারতে আর্থিক অসাম্য বেড়েই চলেছে, তখন অর্থনীতি নিয়ে যাবতীয় তরজার মূলে ছিল জিডিপি-র বৃদ্ধির হার। অর্থাৎ, দেশের মোট সম্পদ কতখানি বাড়ল, অর্থনীতির ভাল-খারাপ মাপার একমাত্র মাপকাঠি সেটাই। আজ থেকে নয়, শুধু ভারতেও নয়— গোটা দুনিয়ায় অর্থনীতির সাফল্য মাপা হয় বৃদ্ধির হারের অঙ্কে। অথচ, আরও একটা মাপকাঠি ছিল। আছেও। আর্থিক অসাম্যের মাপকাঠি— অর্থাৎ, উৎপাদিত সম্পদ কতখানি সুষম ভাবে বণ্টিত হল দেশের সব মানুষের মধ্যে। এই মাপকাঠি ব্যবহার করার জন্য সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে হয় না। সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য উৎপাদনের যাবতীয় অধিকার সরকার বা রাষ্ট্রের কুক্ষিগত করতে হয় না। তার জন্য শুধু বিশ্বাস করতে হয় যে সমৃদ্ধিতে অধিকার সকলের, সেই অধিকার দিতে অস্বীকার করার মধ্যে ঘোর অন্যায় আছে।
অর্থনীতির স্বাস্থ্য মাপার জন্য কোন মাপকাঠিটা ব্যবহার করবে কোনও রাষ্ট্র, সেটা স্থির করে দেয় রাজনীতি। সেই রাজনীতির ভাষ্যই স্থির করে দেয় কোনটা বৈধ আর কোনটা নয়। মাত্র এক শতাংশ মানুষের হাতে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ জমা হলেও যে আমরা তার মধ্যে অন্তহীন ভয়াবহতা দেখতে পাই না, সেটা অকারণ নয়— সম্পদের এই পুঞ্জিভবনের মধ্যে যে একটা চূড়ান্ত অন্যায় আছে, বৃদ্ধির হার-কেন্দ্রিক রাজনীতির ভাষ্য সেই কথাটাই ভুলিয়ে দেয়। কারণ, বৃদ্ধির হার-সর্বস্বতাকে যদি এক বার বৈধ বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে তার পরিণতিগুলোকে প্রশ্ন করার অবকাশ থাকে না।
বৃদ্ধির হারের দৌড়ে কিছু লোক জেতে, আর অনেকে হারে। যারা জেতে, নিজেদের জয়কে প্রশ্ন করার কথা তাদের মনে পড়ে না স্বাভাবিক ভাবেই। মনে পড়ে না, সেই জয়ের পিছনে কত কিছু আছে— ‘ঠিক পরিবারে’, ঠিক বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণি-লিঙ্গ অনুযায়ী জন্ম আছে; পূর্বপুরুষের অর্জিত সম্পদ আছে— এবং, সেই অর্জনের পিছনেও আছে বহু অনর্জিত সুবিধা; শারীরিক সক্ষমতা আছে; এবং আছে সব কিছু ঠিকঠাক চলার মতো ভাগ্যের জোর। মনে পড়ে না, এর কোনওটিই তার ‘অর্জিত’ নয়— এবং, এই অনর্জিত সৌভাগ্যের জোরে যে ‘জয়’, তাকে ন্যায্য পাওনা বলে ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। ভাগ্যের ঙ্গুলিহেলনে গল্পটা অন্য রকম হতেই পারত।
শহরের উচ্চবর্ণের সম্পন্ন পরিবারের বদলে জন্ম হতে পারত কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের দলিত পরিবারে। অথবা, হঠাৎ দুর্ঘটনায় খোয়া যেতে পারত দৃষ্টিশক্তি। বা, নদীর ভাঙনে তলিয়ে যেতে পারত যাবতীয় পার্থিব সম্পদ। অনর্জিত সৌভাগ্যের ওপর যেমন আমাদের কোনও হাত নেই, তেমনই এই দুর্ভাগ্যও আমাদের নিয়ন্ত্রণাতীত হত। এবং, এই দুর্ভাগ্যের শিকার হলে ধনতান্ত্রিক দৌড়ে জেতা কার্যত অসম্ভব হত। যেমন অসম্ভব হয়েছে সেই লোকগুলোর জন্য, যাঁরা আজ মরিয়া হয়ে গ্রামে ফিরতে চাইছেন, শুধু বেঁচে থাকার জন্য।
আরও পড়ুন: সঙ্গত অভিযোগ
রাজনীতি যদি বৃদ্ধির হারের বদলে অসাম্য মোচনের কথা বলত, তা হলে এই কথাগুলো এমন অলীক শোনাত না। তা হলে, জন রল্স নামক মার্কিন দার্শনিকের কথাও হয়তো আরও অনেকে জানতেন। রল্স-এর মূল কথা ছিল, যে সমাজে কেউ জানে না যে তার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করে আছে, সেই সমাজ যে ভঙ্গিতে আর্থিক সম্পদ ভাগ করবে, সেটাই ন্যায্য। যদি সত্যিই না জানি যে আমার সন্তানকে ওই বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের মতো অসহায় অবস্থায় পড়তে হবে কি না— যদি তার সেই অবস্থায় পড়ার সম্ভাবনা সত্যিই থাকে— তা হলেও কি বলব, কেউ জিতবে আর অনেকে হারবে, এই ব্যবস্থাটাই ভাল?
আমরা এই প্রশ্নটার মুখোমুখি দাঁড়াই না, কারণ রাজনীতি আমাদের এই জয়কে প্রশ্ন করতে শেখায়নি। বরং শিখিয়েছে, কী ভাবে নিজের জেতা, আর অন্যদের হেরে যাওয়াকে বৈধ বলে দেখতে হয়। আমরা শিখে নিয়েছি, সাফল্য কারও একচেটিয়া নয়— যথেষ্ট পরিশ্রম করলে, লেগে থাকলে বাজার ব্যবস্থায় যে কেউ সফল হতে পারে। অ্যামেরিকান ড্রিম বস্তুটার মোক্ষম বিশ্বায়ন হয়েছে আমাদের বিশ্বাসে। আমরা কুজ়নেট’স কার্ভ-এ বিশ্বাস করে বলেছি— ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে শেষ অবধি অসাম্য কমবেই। কথাটা ডাহা মিথ্যে— ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি তাঁর ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি নামক মহাগ্রন্থে দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কয়েকটা বছর বাদ দিলে দুনিয়াব্যাপী অসাম্য ক্রমেই বাড়ছে, এবং এখন তার চেহারা প্রায় শিল্প বিপ্লব-উত্তর ইংল্যান্ডের মতো ভয়াবহ— সেই বাস্তব আমরা ধামাচাপা দিয়েছি ছুটকোছাটকা দু’একটা অবিশ্বাস্য সাফল্যের গল্পে।
বারে বারে রাজনীতির ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছি কেন, বলি। সমাজে সুবিধা যাদের হাতে থাকে, তারা সেই সুবিধা টিকিয়ে রাখার জন্য লড়ে যাবে, সেটা স্বাভাবিক। সেই ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে, সেই সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজটা একান্তই রাজনীতির। দুনিয়াব্যাপী রাজনীতি বৃদ্ধির হার-কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান তৈরির কাজে ব্যর্থ হয়েছে। কেন, সে আর এক কাহিনি, আপাতত সেই কথায় ঢোকার প্রয়োজন নেই। রাজনীতির মোড় ফেরাবার সুযোগ ইতিহাসে মাঝেমধ্যে আসে— কোভিড-১৯ তেমনই একটা সুযোগের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দুনিয়াকে। ধনতন্ত্রের অবৈধতা এমন স্পষ্ট ভাবে শেষ কবে ফুটে উঠেছে, বলা মুশকিল। প্রশ্ন হল, এই সুযোগটাকে কী ভাবে ব্যবহার করব? যেমন ভাবে ধনতন্ত্র চলছে, তাকে চলতে দেব— শুধু গরিব মানুষের জন্য আর একটু বেশি দাবিদাওয়া আদায়ের চেষ্টা করব? না কি বলব, বৃদ্ধির হার দিয়ে দেখলে চলবেই না— ওটা কোনও মাপকাঠিই নয়— দেখতে হবে, যতটুকু উৎপাদন হচ্ছে, তার সুষম বণ্টন হচ্ছে কি না? হেরে যাওয়াই যাদের ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছি, ভাগ্যের এ দিক-ও দিকে আমরাও যে সে দলেই থাকতে পারি, এই কথাটা অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে শিখব?
ধনতন্ত্রের অন্তহীন ভয়াবহতা যে তার বণ্টনের অসাম্যে, এই কথাটা এখনও না বুঝলে আর কবে বুঝব আমরা?