করোনা ত্রাস: সুনসান গ্রাম। নিজস্ব চিত্র।
বলতে গেলে জীবনে এমন বাধ্য হইনি কখনও। করোনাভাইরাসের কারণে জনতা কার্ফু থেকে লকডাউনে স্বেচ্ছানির্বাসন মেনে নিয়েছি। তা বলে যে বাড়ি থেকে বার হইনি, তা নয়। গলির মোড়ে মুদির দোকান, ওষুধের দোকানে গিয়েছি। আর জরুরি নির্দেশ মেনে গতকাল এবং গত পরশু গিয়েছিলাম স্কুলে। ছাত্রছাত্রীদের চাল-আলু বিলি করতে।
আমি একজন শিক্ষা সম্প্রসারক। একটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রে পড়াই— পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি। চলতি শিক্ষাবর্ষে আমার প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১০০র কিছু বেশি। এমনিতে সারা বছর ছাত্রদের উপস্থিতি কম থাকে। কেন না, ওরা ওদের হতদরিদ্র সংসারের অভাব মেটাতে উপার্জনের জন্য বাবার সঙ্গী হয়।
অনেকেই জানেন, আমাদের মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলার বহু মানুষ সারা বছর দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকে। কেউ রাজমিস্ত্রির কাজের যুক্ত তো কেউ হকারির সঙ্গে। বছরে দু’তিন বার বাড়িতে আসে। তা-ও পালাপার্বণে।
আর মাসখানেক পরে পবিত্র রমজান মাস। সেই সময় ওদের সবার বাড়ি ফিরে আসার কথা। যেমন প্রতি বছর আসে। আত্মীয়স্বজন থেকে পাড়াপড়শি সবার সঙ্গে পালাপার্বণে অংশগ্রহণ করে। হৈ-হুল্লোড়ে মাতে।
কিন্তু এ বছর ওরা ফিরে আসছে সময়ের অনেক আগেই, নিজে বাঁচতে এবং অন্যকে বাঁচাতে। কর্মস্থলে কাজ বন্ধ। বলা যেতে পারে তাড়া খেয়ে ওরা আসতে বাধ্য হচ্ছে। যখন সব রকম পরিবহণ লকডাউনের কারণে বন্ধ। তবু কী ভাবে আসছে ওরাই জানে!
কিন্তু বাড়িতে এসেও যে ওরা স্বস্তিতে আছে, একেবারে তা নয়। আশ্চর্য হলেও এ কথা সত্যি, ওদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। ইচ্ছে করলেও আত্মীস্বজন, পাড়াপড়শির সঙ্গে ওরা মিশতে পারছে না। সব কিছু এড়িয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
এ ভাবেই ফাঁকা পড়ে রয়েছে গ্রামগুলো।
আমার এক প্রাক্তন ছাত্র, নাম উল্লেখ করছি না। কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকে। এই অবস্থায় ওকেও চলে আসতে হয়েছে। ওর মেয়ে বর্তমানে আমার ছাত্রী। কাল যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর আব্বা বাড়ি এসেছে?
আমার ছাত্রী কোনও উত্তর দেওয়ার আগে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলা বলে উঠলেন, এস্যাছে।
আবার জিগ্যেস করলাম, কী করছে?
— কী করবে আবার! সারা দিন ঘরের ভিতর শুত্যা থাকছে।
— হাসপাতালে গেছিল?
—গেলছিল। কী সব ওষুধ দিয়াছে আর বুল্যাছে ঘরে শুত্যা থাকতে। তাই অইসব খেছে, আর ঘরে শুত্যা থাকছে।
গেলছিল। কী সব ওষুধ দিয়াছে আর বুল্যাছে ঘরে শুত্যা থাকতে। তাই অইসব খেছে, আর ঘরে শুত্যা থাকছে।
ভদ্রমহিলা আমার প্রাক্তন সেই ছাত্রের স্ত্রী। লক্ষ্য করছি, ওর কথায় অস্বস্তি ঝরে পড়ছে। সেই সঙ্গে সঙ্কোচ। স্বামী কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে ঠিকই, হয়তো মজুরি পাইনি। কিংবা পেলেও খুবই অল্প। আবার কবে কাজে যেতে পারবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই ওর চরম অস্বস্তি আছে। আর স্বামী বাড়ি এসেও ডাক্তারের নির্দেশ মেনে ঘরে শুয়ে থাকছে বলে সঙ্কোচ। কে জানে, স্বামী সত্যি সত্যি শরীরে মারণ রোগের জীবাণু বয়ে এনেছে কি না! শুধু পাড়াপড়শিরাই নয়, আত্মীয়স্বজনেরাও কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখছে।
শুধু আমার প্রাক্তন ছাত্রের বা তার স্ত্রীর ক্ষেত্রে নয়, আমাদের চারপাশে আরও অনেকের অবস্থা আজ ঠিক এই রকম। যেমন রেজাউল। বয়স ৩৫। সে-ও কলকাতায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। বৃদ্ধা মা-সহ স্ত্রী-সন্তান মিলিয়ে বাড়িতে তার পোষ্য সংখ্যা পাঁচ জন। একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি সে। তার পর জোহাক আলী। পাটকলের মজুর। মুরসেলিম। পাইপলাইনের কাজের মিস্ত্রি। আমাদের চারপাশে কান পাতুন, এঁদের মতো আরও বহু নাম ভেসে বেড়াচ্ছে ফিসফিস করে, যারা কী অসহায় অবস্থায় চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন-রাত কাটাচ্ছে, ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমরা জানি না, এই বিপদে আমাদের কী হবে, ওরাও জানে না ওদের কী হবে। পার্থক্য এটুকুই, আমি ঘরবন্দি থাকলেও আমার খাবারের চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু ওরা ঘরবন্দি অবস্থায় খাবে কী?
এর মধ্যে আশার কথা, আমাদের মধ্যে এখনও এমন মা আছেন যিনি, মুদির দোকান চালিয়ে ছেলেকে শিক্ষক করেছেন। সেই ছেলে কৃতজ্ঞতা কিংবা মমতাবশত যখন তার মাকে বলে, ‘‘মা তোমাকে আর মুদির দোকান চালাতে হবে না। এমনিতে তুমি সুগারের রুগি। তার পর তোমার বয়স হয়েছে। গ্রামে সব বাইরে থেকে ফিরছে। কে কী নিয়ে ফিরছে কে জানে! তাদের ছোঁয়ায় যদি তোমার কিছু হয়ে যায়?’’
মা উত্তর দেন, ‘‘এরা তো আমাদেরই গ্রামের। কে ভাই, কে ভাতিজা। এদের ছোঁয়া পেয়েই তো আমি তোকে এত বড় করেছি। কই এত দিন তো কিছু হয়নি! তা হলে এখন কেন হবে? দেখিস এক দিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
মায়ের কথা যেন ঠিক হয়। সব ঠিক হয়ে যায়। আর হ্যাঁ, যারা বাইরে থেকে গ্রামে ফিরছেন তাদের প্রতি একটু মানবিক হয়ে আমরাও যেন পরামর্শ দিই, যাতে তারা এই লকডাউন পর্বে নিজের নিজের বাড়িতেই বন্দি থাকে। শারীরিক কোনও অসুবিধা অনুভব করলে, স্থানীয় হাসপাতালে যোগাযোগ করে। কিংবা জেলা সদরের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আমাদের সরকার ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। রাজ্য সরকার তো এই সব পরিবারের জন্য এক হাজার টাকা করে অনুদান দেবার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেটা এতই কম যে, এতে সমস্যা মিটবে বলে মনে হয় না। তাই কেন্দ্র সরকারের কাছেও বিনীত অনুরোধ, এদের জন্য তারাও যেন এগিয়ে আসে। যাতে আমাদের চারপাশে কেউ না খেয়ে না থাকে। না হলে হয়তো দেখা যাবে মারী কখন মন্বন্তরের রূপ নিয়ে ফেলেছে। যা আরও ভয়ঙ্কর!