Coronavirus

কায়া ও ছায়া

উৎস ধরিয়া অসুখ চিহ্নিত করিবার রীতি অনুসারে ইহাকে ‘চিনা ফ্লু’ বা ‘উহান ভাইরাস’ বলা যাইত। কিন্তু এমন আপাত-নিরীহ শব্দবন্ধ যে ক্রমে বর্ণবৈষম্যের জন্ম দেয়, শিখাইয়া দিল কোভিড।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২০ ০০:০৭
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

সঙ্কট কেবল দুষ্ট নহে, তাহার গুণও কিছু আছে। সঙ্কটে না পড়িলে মানবসভ্যতা নূতন কিছু শিখে না, প্রগতিও ঘটে না। সমাধান অন্বেষণে বহু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করিতে হয়, তৎসূত্রে নূতন ভাবনার স্ফুরণ। কখনও নূতন ভাষারও। চতুর্দশ শতকে ইংল্যান্ডে প্লেগ অতিমারি আসিয়া ফরাসি শাসক ঘনিষ্ঠ অভিজাতবর্গকে প্রায় নিঃশেষ করিয়া দিয়াছিল। কিন্তু প্রতি দিন প্রতিকূল পরিবেশে কৃষিকাজে ব্যাপৃত সম্প্রদায়ের প্রাণহানির মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম ছিল। অতিমারি কাটিয়া যাইবার পর বক্তা-সংখ্যার জোরেই কৃষকের ভাষা ইংরেজি নূতন সরকারি ভাষা হয়। দোভাষী-পূর্ব যুগে ক্রমাগত সম্ভাবনার দ্বারগুলিতে আঘাত করিতে করিতেই বাণিজ্যের ক্ষেত্র বিস্তৃত হইয়াছিল। পশ্চিম ইউরোপের সহিত পূর্ব এশিয়ার মিশ্র বকচ্ছপ বুলিতে যোগাযোগ ঘটিয়াছিল। ইংরেজি ‘বিজ়নেস’ চিনা ভাষায় ‘পিজিন’ হইয়াছিল। ক্রমে সেই সকল পিজিন প্রশান্ত ও অতলান্তিক মহাসাগরের বহু দ্বীপবাসীর মাতৃভাষা হইল, যাহা ভাষাতত্ত্বে ক্রেয়োল-ভাষার মর্যাদা লাভ করিল। করোনা সঙ্কটও আধুনিক সভ্যতাকে অনেকগুলি শব্দ শিখাইল এবং অনেকগুলি পুরাতন শব্দকে নূতন চেহারায় পরিচিত করাইল। যেমন, উৎস ধরিয়া অসুখ চিহ্নিত করিবার রীতি অনুসারে ইহাকে ‘চিনা ফ্লু’ বা ‘উহান ভাইরাস’ বলা যাইত। কিন্তু এমন আপাত-নিরীহ শব্দবন্ধ যে ক্রমে বর্ণবৈষম্যের জন্ম দেয়, শিখাইয়া দিল কোভিড।

Advertisement

সমাজ এবং ভাষা সততই যুগলে বহমান। উনিশ শতকীয় কঠোর জীবনযাত্রা ও লিঙ্গবৈষম্যের বিধি দেখিতে দেখিতে বিরক্ত হইয়া ‘ফ্রাস্ট্রেটিং’ শব্দটি তৈয়ারি করিয়াছিলেন ঔপন্যাসিক জর্জ এলিয়ট। চার বৎসর পূর্বে ব্রিটেন যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন হইতে পৃথক হইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল, তখন ‘ব্রিটেন’ ও ‘এক্সিট’ জুড়িয়া প্রস্তুত হইল ‘ব্রেক্সিট’। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির হিসাব বলিতেছে, গত ডিসেম্বরে ‘করোনাভাইরাস’ শব্দটি প্রায় অজ্ঞাত ছিল, এপ্রিল মাসে এক ধাক্কায় তাহার জনপ্রিয়তা কয়েক লক্ষ গুণ বাড়িয়া গিয়াছে। শব্দটি কিন্তু পুরাতন, অনুমান ১৯৬০-এর দশকে জন্ম। ‘কোভিড’ শব্দ অবশ্য মাত্র ফেব্রুয়ারি মাসে তৈয়ারি হইয়াছে। আবার, এপ্রিলে রীতি লঙ্ঘন করিয়া অতিমারির সহিত প্রাসঙ্গিক ‘ইনফোডেমিক’ শব্দটি অভিধানে ঢুকিয়া পড়িয়াছে। বাঙালি সমাজও ব্যতিক্রম নহে। ‘মাস্ক’ বলিতে মুখোশ বিনা কী সে বুঝিত? ‘কোয়রান্টিন’ গল্পের বই ব্যতিরেকে কোথায় ছিল? কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গতি যত দ্রুত, গণমাধ্যম ও হাট-বাজারে তাহার উপস্থিতি যত সরব, নূতন শব্দভাণ্ডার গড়িয়া উঠিবার প্রক্রিয়াও ততোধিক উৎসাহিত। এই বিশেষ সময়টিকে চিনিতে অপরিহার্য উপাদান হইবে নবগঠিত শব্দভাণ্ডার, যাহা মুখে মুখে ফিরিতেছে। শেষাবধি যে সকল শব্দে জনপ্রিয়তার উপাদান অধিক, সেইগুলি কালের বিচারে টিকিয়া যাইবে। ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’ বা ‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দবন্ধ লইয়া যেমন বহু আপত্তি। সঙ্কটের দিনে একে অপরের সহিত ‘শারীরিক দূরত্ব’ বজায় রাখিতে হইবে, কিন্তু সামাজিক ভাবে সকলকে কাছে টানিয়া লওয়া কাম্য। অতএব উহা ‘ফিজ়িক্যাল ডিস্ট্যান্সিং’। অর্জন ও বর্জনের এই প্রক্রিয়াতেই সেই বহতা বজায় থাকে।

দক্ষ প্রশাসককে এই স্রোত অনুধাবন করিতে হয়। বিশেষত সঙ্কটকালে চতুর্দিকে যে তথ্যের বিস্ফোরণ ঘটিতে থাকে, সেই অবাঞ্ছিত ভিড় ঠেলিয়া জনতার নিকট যথাযথ বার্তাগুলি পৌঁছাইয়া দিতে শব্দ ও ভাষার লইয়া অনেকখানি শ্রম ব্যয় করা জরুরি। ছোট ঝকঝকে শব্দভাণ্ডার, সরল যুক্তিক্রম, জনজীবন হইতে উদাহরণ আহরণ এবং স্বল্প সংখ্যক বার্তা। এই কৌশলে ভাষা আগ্রহোদ্দীপক হইয়া উঠে, জনতা সরকারের কথা শুনে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি শাটডাউনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া যে টুইট করিয়াছিলেন নিউ ইয়র্ক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো, তাহার উপকরণ ছিল মাত্র ২৯টি অক্ষর, সাতটি একদলীয় শব্দ। সকল দূষণ ছাপাইয়া বার্তাটি জনতার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিয়াছিল। অতিমারির সময় মনের স্বাস্থ্য-অঙ্গনেও লড়াই চলিতে থাকে। সেই ভীতি লইয়া নাড়াচাড়া করিবার প্রশাসনিক কারবারে অতি সতর্ক না থাকিলে ফল উল্টা হইতে পারে। ইতিহাস দেখাইবে, নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বহুলাংশে তাহার শব্দ নির্বাচনের উপর নির্ভর করে। বৃহত্তর জনতার নিকট পৌঁছাইতে বৃহৎ শব্দবন্ধ বাতিল করিয়া ছোট ছোট কথ্য শব্দ চালু করিবার কথা বলিয়াছিলেন উইনস্টন চার্চিল। ভাষা হইল সমাজের দর্পণ। সমাজের কায়ার মতো দর্পণের ছায়াটিও তাই বার বার পাল্টায়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement