করোনা-আতঙ্কের জেরে লকডাউন শুরু হওয়ার আগের এবং পরের যে সময়, তার মধ্যে আকাশজমিন তফাত। এ বছর ২৩ মার্চের পূর্ববর্তী সময়ের ছবিকে যদি একবার ফিরে দেখা যায়, তা হলে সেটি বিশ্বায়ন এবং তার পরবর্তী প্রভাবে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়ার ছবি। সেই ছবিতে আত্মীয়তা আছে, কিন্তু অবকাশ নেই। দূরত্ব নেই, কিন্তু দৌড় আছে। শিশু আছে, কিন্তু শৈশব নেই।
সে ছবিতে সমাজ ছিল মুখ্যত সামাজিক মাধ্যমে বাঁধা। এই পর্যায়ে আট থেকে আশি মূলত সামাজিক মাধ্যমেই মিলেমিশে একাকার হয়েছিল। সেই সময়ে সময় সময়ের নিময়মাফিকই ছিল। দিন-রাত, সপ্তাহ-মাস এবং বছর কেউ তার নিজস্ব নিয়ম বদলে ফেলেনি। সময় ঠিক নিজের বাঁধাধরা নিয়মে থাকলেও তখন নিজের আর নিজের পরিবারের জন্য সময় তেমন একটা মিলত না। ‘সময় নেই’ শব্দবন্ধ তখন মিথ হয়ে গিয়েছিল বললে একটুও ভুল বলা হবে না।
সময় যখন নিজেই নিজের আগে দৌড়নোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে, ঠিক তখনই একটি ভাইরাস এক নিমেষে সমস্ত ছবিটাই বদলে দিল। নোভেল করোনাভাইরাসের বয়স মাত্র চার মাস। বয়স যেহেতু অত্যন্ত কম, তাই এর কোনও প্রতিষেধক এখনও কারও জানা নেই। ভাইরাসটি মারাত্মক ছোঁয়াচে হওয়ার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইসিএমআর, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার— সবাই মানুষকে যে সব সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে, তার মধ্যে অন্যতম হল বারবার অন্তত কুড়ি সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া। একান্ত প্রয়োজনে লকডাউন চলাকালীন সময়ে যদি বাড়ির বাইরে বেরোতেই হয়, তা হলে নাক-মুখ মাস্ক বা কোনও কাপড় দিয়ে ঢাকা দেওয়া। সেই সময় একজন যেন অন্যজনের থেকে সামাজিক দূরত্ব, অর্থাৎ, নূন্যতম নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন।
ঠিক এখান থেকেই শুরু হয় প্রাক-করোনা পর্বের ছবিবদল। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, লকডাউন চলার এই সময়ে যাঁরা বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন, তাঁরা সবাই অত্যন্ত সচেতন এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করছেন, তা হলে ঠিক কী দেখা যাবে? এঁদের সবারই নাক-মুখ মাস্ক বা রুমাল বা অন্যও কোনও কাপড়ে ঢাকা রয়েছে। তাঁরা বাজারে বা ওষুধের দোকানে সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখছেন। কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে গ্লাভসও পরছেন। লকডাউনের সময়সীমা যেহেতু ৩ মে পর্যন্ত বেড়েছে, সুতরাং এই সতর্ক মানুষরা যে সেই সময় পর্যন্ত যে এই সব সতর্কতা মেনে চলবেন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এর পরে ৩ মে’র পর কী হবে বা কী হবে না, তা সময় বলবে। তবে লকডাউন যত দীর্ঘই হোক না কেন, একদিন তা পুরোপুরি উঠে যাবে। কিন্তু চিনের দৃষ্টান্ত অনুযায়ী তারপরও যে করোনা চিরবিদায় নেবে, তা নাও হতে পারে।
প্রশ্ন হল, সেই সময়ে আমরা কতটা বদলে নেব নিজেদের? এখন যাঁরা বারবার বাড়িতে সাবান দিয়ে বা স্টেরিলাইজার দিয়ে হাত ধুচ্ছেন, তাঁদের কতজন প্রাক-করোনা পর্বে রাস্তার স্টলে ফাস্টফুড বা সাবেক ফুচকা-আলুকাবলি খাওয়ার আগে সতর্ক ভাবে হাত ধুয়েছেন? অথচ, আমরা, এই মানুষগুলোই যেন স্বঘোষিত নাগরিক অধিকার ভেবে পথঘাটের যত্রতত্র থুথু আর পানের পিক ফেলে চিত্রিত করেছি।
গ্রীষ্মের খররোদে যখন একটার পর একটা গাড়ি হু-হু করে রাস্তার ধুলো উড়িয়েছিল, তখনই-বা ঠিক কতজন মাস্ক ব্যবহার করেছিলেন? জলপাইগুড়ি শহর ছাড়িয়ে যেখানে তিস্তা সেতু তৈরি হচ্ছে, সেখানে এই ধুলো ওড়ার ধোঁয়াটে দৃশ্য লকডাউনের আগে প্রতিদিন বাস, গাড়ি বা বাইকে চেপে যাওয়ার সময় হাজার হাজার মানুষ দেখেওছেন। বড়জোর সেই সময়টুকু নাকে-মুখে রুমাল চাপা দেওয়া— সতর্কতা বলতে এটুকুই ছিল তখন। সামাজিক দূরত্ব বিষয়টি তখন অবশ্য অজানা ছিল। এই প্রেক্ষিত থেকে মানুষের আজকের যে সতর্ক অবস্থান, তা ছবিবদল তো বটেই।
লকডাউন পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পর মানুষের আবার দু’টি শ্রেণি তৈরি হবে। সচেতন এবং অসচেতন। যাঁরা অসেচতন, তাঁরা লকডাউন চলার সময় বহু বারই দৃশ্যদূষণ ঘটিয়েছেন। সোজা কথায়, এঁরা এখনও সতর্ক হতে শেখেননি। কিন্তু এঁদের তুলনায় সচেতন মানুষের সংখ্যাটা অনেক বেশি। কিন্তু লকডাউন উঠে যাওয়ার পর তাঁরা কী করবেন?
ভিড়ে ঠাসা কোনও বাজার বা হাটের ছবি দেখে অনেকেই এখন আঁতকে উঠছেন। লকডাউন উঠে যাওয়ার পরও বাজার-হাট-দোকানে অনেকেই নিশ্চয় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে চাইবেন। কিন্তু তখন সচেতন আর অসচেতন— দু’য়ের সংঘাত তৈরি হবে না তো?
এই পর্বে ‘সামাজিকতা’ শব্দটিও প্রশ্নের মুখোমুখি হবে। শিক্ষক, মা-বাবা বা গুরুজনস্থানীয় কাউকে কেউ প্রণাম জানাতে এলে রীতি ভেঙে তখন কি নিষেধ করতে হবে? একই রকম ভাবে সামাজিক যোগাযোগও কি এই পর্বে সীমাবদ্ধ হয়ে আসবে? প্রশ্ন থেকে যায়, জন্মদিন, বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মতো সামাজিক আমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করা নিয়েও। সামাজিকতা আর সতর্কতার এই লড়াইয়ে কে জিতবে, তার উত্তর সময়ই দেবে।
পাশাপাশি, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি— এ সবের পরেও লকডাউন-পরবর্তী পর্বেও সতর্কতা খুবই জরুরি। সচেতন শ্রেণির সদস্যসংখ্যা বাড়াটাও জরুরি। মানুষকে সচেতন করে তুলতে সরকারি উদ্যোগের কোনও খামতি নেই। কিন্তু বিপদের গুরুত্ব বুঝে সচেতনতা গড়ে না উঠলে সামনের দিন সুখকর নাও হতে পারে।
করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করা একদিন নিশ্চয়ই সম্ভব হবে। তবে, জীবন আর জীবিকার কারণে ততদিন লকডাউন চালিয়ে যাওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। এই অবরোধ উঠে গেলেও সরকারি সতর্কবার্তা নিশ্চয়ই থাকবে। সেই বার্তা অবশ্যই মেনে চলা উচিত। তাতে যদি নিজেদের অনেকটা বদলেও নিতে হয় তা হলেও। না হলে সমস্ত স্তরের সমস্ত উদ্যোগই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমরা কতদিন এবং কতটা সতর্ক থাকতে পারব, সেটাই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করবে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)