করোনাভাইরাস এখন সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে জন্ম নিচ্ছে প্রশ্ন, তার চেয়েও বেশি আতঙ্ক। কী হচ্ছে, অনেকের কাছেই তা ধোঁয়াশা। সত্যতা যাচাই না করেই ভেবে নিচ্ছেন অনেক কিছু, করছেন অনেক কিছু। ঠিক এই ব্যবহারটাই জনস্বাস্থ্যের অন্যতম শত্রু। এ কথা ঠিক যে, এ রকম অতিমারি বিগত অনেক দশক পৃথিবী দেখেনি, এবং ছেলেখেলা করার কোনও জায়গা নেই। তবে এ কথাও ঠিক যে, মানবজাতি বোধ হয় অতিমারি বা মহামারি রোধের জন্য এতটা প্রস্তুতও কখনও ছিল না। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এর একটা চর্চা করলে এ নিয়ে অযথা আতঙ্কটা হয়তো কমবে।
প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে, ইবোলা, জিকা ভাইরাস তো এত দাবানলের মতো ছড়ায়নি, তবে হঠাৎ করোনা কেন? কারণ আন্দাজ করা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে, চিন থেকে এর উৎপত্তি। চিন এখন পৃথিবীর অর্থনীতির ইঞ্জিন। আর তার থেকেই কাঁচামাল আর প্রচুর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নেয় উন্নত দেশগুলি। স্বভাবতই সেই আন্তর্জাতিক বিমানযাত্রার হাত ধরে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে খুব দ্রুত, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকায়। একে বিশ্বায়ন বা মুক্ত অর্থনীতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও বলা যায়। এমনকি করোনা-অধ্যুষিত আর একটি দেশ ইরানের সঙ্গেও চিনের যোগসূত্র দৃঢ়। তার ওপর এই ভাইরাসের কয়েকটি বিশেষ প্রকৃতি একে ছড়াতে সাহায্য করেছে। তবে চিন সরকার চেষ্টা করলে খুব শক্ত হাতে ধরতে পারে রাষ্ট্রব্যবস্থা। তারই হাত ধরে তারা দ্রুত কমিয়ে আনতে পেরেছে সংক্রমণ। আর এখানেই কঠোর সরকারের জয়।
আসলে খুব পরিণত গণতন্ত্র ছাড়া, শুধু মানুষের ওপর ভরসা করে এ ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলা অসম্ভব, বিশেষত এই ধরনের ক্ষেত্রে, যেখানে এক জন মানুষের ক্রিয়াকলাপের ওপর শুধু তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে না, করছে পুরো সমাজের। তার চেয়েও বড় মুশকিল, সমাজের পক্ষে যে কাজটি ইতিবাচক, ইচ্ছে থাকলেও সেটা করার উপায় অনেকেরই নেই। যেমন, এই সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাড়িতে বসে থাকতে হলে চাকরিজীবী ছাড়া কারও ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা সুবিধার হবে না, বরং লোকসান হবে অনেক বেশি। নিজের সুবিধে না হলে সেই কাজ করব না— এই ভাবনা মানুষের মজ্জাগত। একে শুধু শুভবুদ্ধির দোহাই দিয়ে ঠিক করা যায় না। সুতরাং, মানুষের ওপর আস্থা অতটা না রেখে রাষ্ট্রের হাত শক্ত করতেই হবে। তাই যতই ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ হোক, মহামারি আইন চালু করার উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়।
আজ রাষ্ট্রের হাত শিথিল করার মাসুল দিতে হচ্ছে ইরানকে। সেখানে বিপদসঙ্কেত সত্ত্বেও বহু দিন অবধি সরকার মানতেই চায়নি, বিপদ আসছে। আসলে কামুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটির শুরুর মতোই ভাবতে খুব ইচ্ছে করে: ওদের হচ্ছে, আমাদের হবে না। সেটা জনস্বাস্থ্যের আর একটি সঙ্কট। ১৯১৮-র ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি শিখিয়েছে, সরকারকে চোখ-কান খুলে মানতে হবে, এবং যতটা সম্ভব ব্যবস্থা করে জনগণের কাছে সত্যিটা বলতে হবে, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি যতই ক্ষুণ্ণ হোক। অন্য দিকে, একই ভাবে ইটালির সরকারকেও দোষ দেওয়ার আগে ভাবতে হবে যে, সে দেশের ষাটোর্ধ্ব মানুষ অনেক বেশি, যাঁদের মধ্যে করোনার মারণশক্তি সর্বাধিক। তার ওপর, শুধু করোনা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাই হয়তো গাণিতিক নিয়মেই মৃত্যুহার ইটালিতে বেড়ে গিয়েছে। তবে, ইটালিতে এতটা সংক্রমণ হলই বা কেন, এ যুক্তি কিন্তু ব্যাখ্যা করে না।
আমেরিকা বা ব্রিটেনেরও বোধ হয় একটু দেরিতেই টনক নড়ছে। সেখানে হয়তো ব্যক্তিস্বাধীনতা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে নিয়ন্ত্রক কোনও ব্যবস্থা করার আগে রাষ্ট্রনেতাদের ভাবতে হয়েছে অনেকটাই। এশিয়ার পুঁজিবাদের মডেল দেশগুলি, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপান যে ভাবে এর প্রকোপকে অনেকটাই রোধ করছে, তা শেখার মতো। হয়তো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির স্বভাবই হল একটু শৃঙ্খলার মধ্যে চলা, রাষ্ট্রের কথা মানা। তাই রাষ্ট্র, উপস্থিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের মনন, হয়তো বা আবহাওয়া— সবেরই প্রতিফলন ঘটবে এই করোনা-মোকাবিলায়।
ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা যেমন দেখিয়েছেন যে শুধু গণতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র মানেই দুনিয়ার সর্বত্র এক মডেল নয়, তেমনই করোনা মোকাবিলার স্কোরশিট নির্ধারণ করবে নানা ব্যাপার। গাণিতিক নিয়ম, না রাজনৈতিক অবস্থান, না কোনও নিছক জৈবিক নিয়মে কোনও দেশের প্রকোপ বেশি বা কম, এ নিয়ে গবেষণা চলুক, কিন্তু মনে রাখতে হবে, জনস্বাস্থ্য বরাবর চিকিৎসাবিদ্যার বইয়ের পাতা থেকে ডানা মেলে উড়তে চায় অর্থনীতি, রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব ও সংখ্যাতত্ত্বের পরিসরে।
এ বার ভারতের কথায় আসি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে মহামারিটি চারটি পর্যায়ে হচ্ছে। প্রথমে বিদেশ থেকে আগত কিছু লোকের দেহে সংক্রমণ আছে (স্টেজ ১), তাঁদের খুব কাছের যাঁরা, তাঁদের হচ্ছে (স্টেজ ২), তাঁরা বৃহত্তর সমাজে যখন যাচ্ছেন, অন্যদের সংক্রমণ ঘটাচ্ছেন একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক জায়গা ধরে (স্টেজ ৩), তার পর এতটাই ছড়িয়ে যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট কোনও নিয়ম পাওয়া যাচ্ছে না (স্টেজ ৪)। তাই বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের উপসর্গ থাকলে তৎক্ষণাৎ পরীক্ষা করা এবং ১৪ দিন ঘরবন্দি করা (উপসর্গ না থাকলেও), বা তাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা এবং ঘরবন্দি করা স্টেজ ১ আর ২ মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। আইসিএমআর পরীক্ষা করে যাচ্ছে ‘সেন্টিনেল সারভাইলেন্স’ দিয়ে সাধারণ লোকের মধ্যে প্রকোপ আসতে শুরু করেছে কি না, আর তার উত্তর কিন্তু স্বস্তিদায়ক। ভারত গত ১৫ বছর ধরে বিপর্যয় মোকাবিলা, অসুখের নজরদারি, প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্বমানে পৌঁছে গিয়েছে। তার ফল পাওয়া যাবে কি না, বোঝা যাবে সামনের ক’দিনে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বলছে, ভারত প্রস্তুত।
আর, শুধু সরকারের দিকে না চেয়ে আমাদের যে কাজগুলি করতে বলা হচ্ছে, সেগুলো করে যেতে হবে। এ লড়াই কিন্তু অনেক দিনের।
কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ, আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ