Education

ভাইরাসের আর এক শিকার

ভারতের মতো গরিব দেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়াশোনা আসলে বৈষম্যকে আরও পোক্ত করবে।

Advertisement

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২০ ০০:০২
Share:

ভোর সাড়ে ছ’টায় বাড়ি থেকে সাইকেল নিয়ে গুসকরা স্টেশন যেত সুদীপ সোরেন। তার পর কলকাতাগামী এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরা, বর্ধমান থেকে লোকাল, ডানকুনিতে ট্রেন বদল, শিয়ালদহ থেকে দক্ষিণ শাখায় যাদবপুর। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়। সপ্তাহে পাঁচ দিন এই অমানুষিক রুটিনটা না মানলে এগারোটা দশের প্রথম ক্লাসটা করা হত না সুদীপের। ভাল করে এমএ পড়তে পাশ করতে হবে, তাই ক্লাসগুলো করতে হবে, আবার বাড়িতে একা মা-কে দেখতেও হবে। সুদীপ এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।

Advertisement

রাত ন’টায় যাদবপুর ক্যাম্পাস থেকে বেরোত তটিনী দত্ত। লাইব্রেরি বন্ধ হয় তখন। রোজ রোজ এত কী পড়া? বাড়িতে বই নেই, কেনার মতো টাকাও নেই, পড়ার সময়ও নেই, সুযোগ তাই ওই একটাই। মাঝে কিছু দিন পড়া ছেড়ে চাকরি করে আবার পড়ায় ফিরেছে সে। অনলাইন পড়াশোনা স্বভাবতই তার কাছে ক্যাম্পাসের পড়াশোনার তুল্য হতেই পারে না।

ডিজিটাল লেখাপড়া নিয়ে ফিসফাস শুরু হতেই এই গল্পদু’টো মনে পড়ে গেল। এ দেশে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচতারা হলেও তার সব পড়ুয়ারা অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে আসে না। বরং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জেএনইউ বলে দেয়, এ দেশের সবচেয়ে ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কী ভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার সুযোগ পায়। তাই জন্যই মাননীয় উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বলেছেন, অনলাইন ক্লাসে তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু পড়ুয়াদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিচার করা উচিত।

Advertisement

বস্তুত এ একটা অহঙ্কার করার মতো বাস্তব। আমাদের দেশে যারা লেখাপড়া করে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সব স্তরেই, তাদের মধ্যে ধনীর চেয়ে গরিবের সংখ্যাই বেশি। শহরের চেয়ে বেশি মফস্‌সল বা গ্রামে থাকে পড়ুয়ারা। প্রথমটার সঙ্গে যুক্ত কম্পিউটার বা স্মার্টফোন কেনার ক্ষমতা। এবং দ্বিতীয়ের সঙ্গে যুক্ত ইন্টারনেট সংযোগের গুণমান। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শক্তি হল, সমাজের সব অংশের ছেলেমেয়েরা একই ক্লাসঘরে পাশাপাশি বসে একই শিক্ষকের থেকে পড়া শোনে। লাইব্রেরিতে তাদের সকলের জন্য একই রকম বই সাজানো থাকে, তাতে সকলের একই রকম অধিকার। তারা একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে একই ডিগ্রি পায়। পুরো ব্যবস্থাটা ডিজিটালে উঠে গেলে প্রাথমিক ভাবে এই সৌন্দর্যটা হারিয়ে যাবে। যার বেশি টাকাপয়সা নেই, তার দামি স্মার্টফোন নেই, দ্রুত গতির ইন্টারনেট নেই। তাই ক্লাসে সে পিছিয়ে পড়তে থাকবে। লাইব্রেরিও নেই। তাই নিজের সাধ্য অনুযায়ী বইপত্র জোগাড় করতে হবে। যাদের আর্থিক জোর নেই, এ ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে পড়বে। ইউনেস্কো বলেছে— ‘অনলাইন পড়াশোনা সবাইকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এই ভাবনা বিভ্রম বই কিছু নয়।’ ভারতের মতো গরিব দেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়াশোনা আসলে বৈষম্যকে আরও পোক্ত করবে। টাকাপয়সা না থাকলে লেখাপড়া হবে না। এ কথা কিন্তু আমাদের শিক্ষার মর্ম ও সংবিধানের সাম্য ভাবনার পরিপন্থী।

অনলাইনে কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়া, ফর্ম ফিল-আপ, বেতন জমা ইত্যাদি নানা কাজই তো চলে। সেটা তো সবাইকেই করতে হয়, পড়াশোনাই বা হবে না কেন? প্রথমত সেটা দৈনন্দিন কাজ নয়। দ্বিতীয়ত, এ ক্ষেত্রে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার অনেকাংশে গোষ্ঠীগত— অনেকেই সাইবার ক্যাফেতে কাজ সারে।

তবে কি ডিজিটাল ব্যবস্থা পরিত্যাজ্য? নিশ্চয়ই নয়। ইন্টারনেটের মস্ত সুবিধে হল, তা মানুষকে দু’টো প্রায়-শাশ্বত বিষয় থেকে মুক্তি দিয়েছে: স্থান ও কাল। এবং এত দিন অবধি মানুষের যা অসাধ্য ছিল, তার অনেক কিছু‌ই প্রযুক্তি করে দেখিয়েছে। সেই অসামান্য সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছাত্রছাত্রীদের যতটা সুবিধে করে দেওয়া যায়, ততটাই তার উপকারিতা। অর্থাৎ এই ফাঁকা সময়ে কিছু মালমশলা, ভাবনার খোরাক তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া গেল। তবে সিলেবাসের পড়াশোনা নিয়ে এই মঞ্চকে পরিপূর্ণ ক্লাসঘরের বিকল্প বানিয়ে না ফেলাই বাঞ্ছনীয়। অনেক স্কুল-কলেজ অবশ্য এই কাজটা করছেও।

তবে ডিজিটাল মঞ্চ কাজের গতিকে মসৃণ করে দিলেও তার বুনিয়াদ গায়েগতরে খাটনির ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে। অনলাইনে ক্লাস চললেও নোট লিখতে হয় খাতায়-কলমে। ডিজিটাল ব্যবস্থায় আমরা নিশ্চয়ই এগোতে পারছি, কিন্তু তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবা ভুল। তাই লেখাপড়ার সম্পদ সকলের কাছে সমান ভাবে পৌঁছচ্ছে কি না, নতুন মঞ্চের ফলে কেউ বঞ্চিত হচ্ছে কি না, যাদের সামর্থ্য কম তাদের কেউ বাদ পড়ে যাচ্ছে কি না, এগুলো লক্ষ রাখতে হবে। আসলে, ডিজিটাল মঞ্চের কারণে যদি বড়লোক-গরিব বা শহর-গ্রামে কোনও বিভাজন ঘটে যায়, তা হলে তার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। যে শিক্ষার্থী এখন পিছিয়ে পড়ল, সে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তেই থাকবে। এই ব্যবস্থা হয়তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এই তৈরি হওয়া ফাঁকটা চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। ইন্টারনেট বা কম্পিউটার নেই বলে যে কম শিখল বা শিখল না, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তার পড়া গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কেউ নেবে?

দেশে ডিজিটাল সাক্ষরতার হার এখনও দশ শতাংশও নয়, অতএব সতর্ক ভাবে পা ফেলতে হবে। আপাতত অন্য উপায় নেই ঠিকই। চিনও একই সমস্যায় জর্জরিত। আরও অনেক দেশও। এমনকি ধনী দেশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে অনলাইন শিক্ষা সমস্যাবিহীন নয়, কেননা অধিকাংশ ধনী দেশেও প্রচুর পরিমাণ অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাই বলা যেতেই পারে যে, কেবল এ দেশে নয়, বিশ্বের অন্যান্য কোণেও করোনা প্যানডেমিকের শিকার হতে চলেছে স্কুলশিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement