প্রতিপালক সমাজের খোঁজে
Health

জীবনটাকে নতুন করে ভাবার সুযোগ এনে দিয়েছে অতিমারি

ঘটনা হল, অতিমারিতে আক্রান্ত হওয়ার পক্ষে ভারতীয় অর্থনীতিতে এটা সম্ভবত ভয়ঙ্করতম সময়।

Advertisement

কৌশিক বসু ও এলা ভট্ট

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২০ ০০:০১
Share:

শুধু যে এখনও কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে, তা নয়— পাশাপাশি আমরা সাক্ষী থাকছি এক আশ্চর্য মানবিক সঙ্কটের।

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের এত দিনের চেনা দুনিয়াটাকে আমূল পাল্টে দিল কোভিড-১৯ অতিমারি। পৃথিবী জুড়ে সব দেশের সরকার লড়ছে যাতে এই অতিমারির সংক্রমণে লাগাম পরানো যায়। এ দিকে, বেকারত্বের হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, খাদ্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান বিঘ্নিত— দুনিয়ার ওপর আর্থিক মন্দার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে। এই অবস্থায় হতাশা স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই বিপন্ন সময়টি ভেবে দেখার অবকাশও দিয়েছে আমাদের— নিজেদের জীবনযাত্রার ধরনটাকে বিচার করে দেখার অবকাশ। এই বিপর্যয় থেকেও যে ফিরে আসা যায়, এই কথাটা ভাবার সময় এখন।

Advertisement

হাল ছেড়ে দেওয়ার কারণ অনেক। গোটা দুনিয়াতেই দেখছি, রাজনৈতিক নেতারা এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াইয়ের নীতি নিয়ে দোলাচলে ভুগছেন— তার ফলে রোগ অনেক বেশি মারাত্মক হয়ে উঠছে। সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুর হারও। অনেক দেশেই এখনও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে দ্রুত হারে। আশঙ্কা, কিছু দিনের মধ্যেই অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে হবে।

ভারতে এই সঙ্কট আর একটি বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। শুধু যে এখনও কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে, তা নয়— পাশাপাশি আমরা সাক্ষী থাকছি এক আশ্চর্য মানবিক সঙ্কটের। আমাদের দেশের শ্রমিকরা, পরিযায়ীরা, কোটি কোটি স্ব-নিযুক্ত মানুষ এক অভূতপূর্ব আর্থিক সঙ্কটের শিকার হয়েছেন। রোগের আক্রমণে কত জন প্রাণ হারালেন, সেই হিসেব প্রতি দিনই রাখা হচ্ছে। কিন্তু, ক্ষুধায় বা দারিদ্রের ছোবলে দেশের দুর্বলতম জনগোষ্ঠীকে কী মূল্য চোকাতে হচ্ছে, তার কোনও পাকা হিসেব এখনও কষা হয়নি। আমাদের দেশের শ্রমিকদের সঙ্গে আমরা যে আচরণ করেছি— বিশেষত দরিদ্র পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে, মহিলা শ্রমিকদের সঙ্গে— তা অতি দুর্ভাগ্যজনক। তাঁরা সুতীব্র দারিদ্রের জ্বালায় বাড়ি ছেড়ে, আত্মীয়-পরিজনদের ছেড়ে বহু দূরের কোনও রাজ্যে কাজের খোঁজে গিয়েছিলেন। শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সংস্থান করতে যে মানুষকে এতখানি ত্যাগস্বীকার করতে হয়, সেটাই অতি দুঃখের, অতি লজ্জার। হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা করার ফলে তাঁরা বিপন্নতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছলেন। রাতারাতি কাজ হারালেন, হাতে টাকা থাকল না, পাতে অন্ন থাকল না— তাঁরা কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করলেন। রাস্তাতেই প্রাণ হারালেন বহু মানুষ। এই ঘটনা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অনপনেয় কলঙ্ক হিসেবে থেকে যাবে। এ আমাদের সম্মিলিত লজ্জা। আমাদের জাতিগত পাপ।

Advertisement

আরও পড়ুন: বেঁচে থাকা যে রকম হয়

এটা রাজনীতির সময় নয়। এখন আমাদের এক সঙ্গে পথ চলতে হবে। সমাজের দরিদ্রতম, দুর্বলতম জনগোষ্ঠীর জন্য কী ভাবে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, অতিমারি-উত্তর সময়ে কী ভাবে ভারতীয় অর্থনীতিকে ফের বৃদ্ধির পথে, সর্বজনীন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, আমাদের সেই কথা ভাবতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য সে জন্য আমাদের সেরা পরামর্শটা দেওয়া, সাধ্য অনুযায়ী কাজ করা।

ঘটনা হল, অতিমারিতে আক্রান্ত হওয়ার পক্ষে ভারতীয় অর্থনীতিতে এটা সম্ভবত ভয়ঙ্করতম সময়। ২০১৬ সাল থেকেই দেশের অর্থনীতি গভীর ভাবে বিপর্যস্ত। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে, অর্থাৎ অতিমারির প্রকোপে পড়ার আগেই, ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছিল ৪.২ শতাংশে। গত এগারো বছরে কখনও বৃদ্ধির হার এত কম হয়নি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম ঐতিহাসিক তলানিতে। এই অবস্থায় তো ভারতীয় অর্থনীতির এমন হাঁড়ির হাল হওয়ার কথা ছিল না। নন-ফুড ব্যাঙ্ক ক্রেডিট, অর্থাৎ খাদ্য ব্যতীত অন্য খাতে ব্যাঙ্কের ঋণের বৃদ্ধির পরিমাণ অর্থব্যবস্থার চলনের একটা নির্ভরযোগ্য সূচক। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সেই হার সাত শতাংশের নীচে চলে গিয়েছিল। গত অর্ধ শতকে সর্বনিম্ন।

অতিমারির প্রকোপ আরম্ভ হওয়ার পর স্বভাবতই পরিস্থিতি আরও খারাপ হল। এ বছর মার্চে ১৬০০ কোটি ডলার মূল্যের বিদেশি লগ্নি ভারত থেকে বেরিয়ে গেল। এর আগে কখনও এত পরিমাণ বিদেশি লগ্নি দেশ ছাড়েনি। দেশ জুড়ে লকডাউন চালু হওয়ার পর এপ্রিলে বেকারত্বের হার পৌঁছল ২৩.৮ শতাংশে। এটাও রেকর্ড। সে মাসেই ভারতের রফতানির পরিমাণ হ্রাস পেল ৬০ শতাংশ। শুধু ভারতের নিরিখে নয়, গোটা উন্নয়নশীল দুনিয়ার নিরিখেই রফতানির এই সঙ্কোচন রীতিমতো ব্যতিক্রমী। আশঙ্কা হচ্ছে, এই বছর ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যাবে— ১৯৭৯-৮০ অর্থবর্ষের প্রবল পতনের চেয়েও সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে।

আমরা এই নিবন্ধটি লিখছি একটি কথা ফের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য— এই সঙ্কটের মুহূর্ত সহমর্মিতা দাবি করে। মহাত্মা গাঁধী বলেছিলেন, “তোমার দেখা দরিদ্রতম, দুর্বলতম মানুষটির মুখ মনে করো, এবং নিজেকে জিজ্ঞাসা করো, তুমি যা করছ, তাতে কি সেই মানুষটির কোনও উপকার হবে?” মার্কিন দার্শনিক জন রল্‌সের হাত ধরে গাঁধীর এই নীতিটি আধুনিক দর্শনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে অতিমারির প্রকোপ আরম্ভ হওয়ার পর থেকে আমরা যে ভাবে নিজেদের, নিজের প্রিয়জনদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছি, এবং দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষকে ছেড়ে দিয়েছি ভাগ্যের হাতে, তাতে আমরা গাঁধীর এই নীতি থেকে আরও, আরও দূরে সরে গিয়েছি।

আমরা এই নিবন্ধটি লিখছি একটা আশা নিয়ে— একটা স্নেহময়, প্রতিপালক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আশা। কোনও আর্থিক নীতি, কোনও রাজনৈতিক অবস্থানই তার নিজের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না— সেই নীতি, সেই অবস্থান তখনই গুরুত্বপূর্ণ, যখন তা একটি সর্বজনীন, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রতিপালক সমাজ গড়ে তুলতে পারে। এমন সমাজ, যেখানে সব ধর্মের, সব বর্ণের, জাতের, লিঙ্গের মানুষ সমান ভাবে নিরাপদ বোধ করবে। আমরা প্রত্যেকেই যদি শৈশবে প্রতিপালিত না হতাম, তা হলে কি আজকে যে যেটুকু হতে পেরেছি, তা পারতাম? দুঃখজনক ভাবে, এই কথাটা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, এবং সমাজকে শুধুই শোষণ করতে চাই। আর সবাইকে বঞ্চিত করে শুধু নিজেদের আখেরটুকু গুছিয়ে নিতে চাই। গোটা দুনিয়ার বাস্তুতন্ত্রকে বিপন্ন করে নিজেদের সম্পদ বাড়িয়ে তুলতে চাই। এই আচরণের ফল কী, তা ভারতের বর্তমান সঙ্কট দেখে বোঝা সম্ভব— এক দিকে অঢেল সমৃদ্ধি, আর অন্য দিকে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, বেকারত্ব; অসহিষ্ণুতা আর হিংস্রতা বেড়েই চলেছে; পরিবেশ দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসের দোরগোড়ায়।

ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আশাবাদী। এই দেশের সংস্কৃতিতে, জাতিগত বোধে এমন অনেক কিছু আছে, আমরা যার থেকে ভবিষ্যতের পথনির্দেশ পেতে পারি। এমন একটা জীবনের পথে হাঁটতে পারি যা মাটিকে ভুলবে না। এমন সুস্থায়ী পরিবেশ তৈরি করবে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধারণ করতে পারে। আমাদের এমন একটা সমাজ তৈরি করতে হবে যা জ্ঞানকে সম্মান করবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি আস্থাবান হবে, নিজেদের সংস্কৃতি বিস্মৃত হবে না। অন্যদের সঙ্গে আমরা শুধু সেই আচরণটুকুই করব, যেটা অন্য কেউ আমাদের সঙ্গে করলে আমাদের আপত্তি থাকবে না।

ভারতের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। কিন্তু, ভারত দুনিয়ার ধনীতম দেশ হয়ে উঠুক, আমাদের আকাঙ্ক্ষা তা নয়। আমরা চাই, ভারত দুনিয়ার সামনে সমবণ্টনের আদর্শ উদাহরণ হয়ে উঠুক— এমন একটা সমাজ হয়ে উঠুক, যেখানে কেউ আয়হীন থাকবে না, কর্মহীন থাকবে না, সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে কেউ নিরাপত্তার অভাব বোধ করবে না, বঞ্চনার শিকার হবে না। আমরা জানি, ইতিহাস অনেক অবিচারের সাক্ষী— এক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অন্য জনগোষ্ঠীর অবিচার। কিন্তু, আমরা যদি আজীবন ইতিহাসের সেই ক্ষত বহন করে চলি, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? চোখের বদলে চোখ, এই নীতি আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে, সে তো জানা কথা।

আশা করি, এই অতিমারি-আক্রান্ত সময়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে, বর্তমান হতাশা থেকেই উঠে আসবে এক অন্য ভবিষ্যৎ— এক প্রতিপালক সমাজের ভবিষ্যৎ।

অর্থনীতি বিভাগ, কর্নেল ইউনিভার্সিটি; আচার্য, গুজরাত বিদ্যাপীঠ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement