Coronavirus

এখন সময় আরও বেশি করে সামাজিক-মানবিক হয়ে ওঠার

করোনাভাইরাসের দাপটে ঘুচেছে স্থিতাবস্থা। সংক্রমণ এড়াতে পৃথক থাকাই এখন কর্তব্য। কিন্তু মানসিক ভাবে জোটবদ্ধ থাকারও সময় এটা।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা, বিশ্বব্যাপী এই অতিমারিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান আরও বাড়তে পারে।

Advertisement

শঙ্খনাদ আচার্য

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০২:৫৪
Share:

করোনাভাইরাস এই মুহূর্তে প্রায় গোটা বিশ্বকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। এই মারণ ভাইরাসের করাল থাবায় আক্রান্ত বিশ্বের অন্তত ১৮২টি দেশ। বিশ্বের দু’লক্ষেরও বেশি লোক এই ভাইরাসে সংক্রমিত এবং ইতিমধ্যেই এই জীবাণু ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা, বিশ্বব্যাপী এই অতিমারিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান আরও বাড়তে পারে। যার প্রভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলির বহু শহর বর্তমানে অবরুদ্ধ ও স্তব্ধ। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা একই সুরে বার্তা দিচ্ছেন যে, এই ভাইরাস মোকাবিলা করতে আমাদের সর্বদা সচেতন থাকতে হবে এবং মানসিক ভাবে জোটবদ্ধ হয়ে যথাসম্ভব পৃথক থাকতে হবে। না হলে একে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।

এই ভাইরাসের মোকাবিলায় সচেতন থাকা এবং বিচ্ছিন্ন থাকা কতটা জরুরি, তা আমাদের দেশের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। গত ৩০ জানুয়ারি আমাদের দেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া যায়। তার দেড় মাসের মধ্যে সেই সংখ্যাটা লাফিয়ে আজ ২০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত স্বস্তিতে থাকা আমাদের রাজ্য এ সপ্তাহে সেই আক্রান্তের তালিকায় নাম লিখিয়েছে।

Advertisement

কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলো একযোগে জোরকদমে এই ভাইরাস প্রতিরোধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং যথাসাধ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। তাই আমাদেরও সচেতন থাকা এবং আলাদা থাকা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। আলাদা থাকার সুযোগ করে দিতেই বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মতো আমাদের রাজ্যেও বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু প্রেক্ষাগৃহ, বিনোদনের কেন্দ্র ইতিমধ্যেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বহু বেসরকারি ও বহুজাতিক সংস্থা তাদের কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। এর ফলে কর্মব্যস্ত জীবনে এসেছে নিরবচ্ছিন্ন অবসর যাপনের সুযোগ।

বঙ্গসমাজ আজ অখণ্ড অবসর যাপনের উপায় খুঁজতে দ্বিধাবিভক্ত। ভ্রমণপিপাসু বাঙালির উড়ু-উড়ু মন তো এই সময় সপরিবার বেরিয়ে পড়তে চায় অজানা পথে, প্রকৃতির সন্ধানে। হয় পাহাড়ে, নয় সাগরে। সে আজ এই ভাইরাসের আতঙ্কে একপ্রকার গৃহবন্দি! সপ্তাহান্তে পরিবার নিয়ে বিনোদন পার্কে কিংবা প্রেক্ষাগৃহে হইহুল্লোড়ে মেতে থাকা বাঙালিও আজ যেন মনমরা। টিভি ধারাবাহিকও বন্ধের মুখে। কারণ, সংক্রমণের আশঙ্কায় টলিপাড়ায় সমস্ত রকম শুটিংয়ের কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। কতদিন যে আর ধারাবাহিকের নতুন পর্ব চলবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ দিকে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় বন্ধ হওয়ায় শিশু-কিশোরদেরও এক প্রকার বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ। তার উপরে আবার বাড়িতে সর্বদা অতন্দ্র প্রহরায় পড়াশোনার কড়া নির্দেশ। এদের সকলের গলায় আজ আক্ষেপের একটাই সুর— তা হলে কী করব! এই প্রশ্নের উত্তরে নিঃসংকোচে বলা যায়, এই অবসর প্রকৃতির স্নিগ্ধতা গায়ে মাখার অবসর নয়, এ অবসর বিনোদন যাপনেরও নয়। এ অবসর সচেতনতা প্রসারের অবসর, নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সুস্থ-সবল রাখার অবসর। মানসিক ভাবে জোটবদ্ধ হয়ে আলাদা থাকার অবসর। সর্বোপরি এই অবসর প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে নির্ধারিত স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে প্রকৃত ভারতবাসী হয়ে ওঠার অবসর।

ভাইরাসের কবল থেকে বাঁচতে বিচ্ছিন্ন থাকার ক্ষেত্রে এ তো গেল আক্ষেপের কথা। এ বার আসা যাক আকুতির কথায়। আকুতি মানে, সমাজের নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনের আকুতি। অর্থাৎ, দারিদ্রসীমার নীচে বাস করা মানুষের আর্তি, পথবাসী মানুষের আকূতি, ভিক্ষাজীবী মানুষের আকুলতা, অসংগঠিত শ্রমিকের আকুতি।

যে মানুষটা বিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়ের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি বা ফুচকা বিক্রি করেন, যে মানুষটা বিনোদন পার্ক বা প্রেক্ষাগৃহের সামনে বাদাম ভাজা বা রংবাহারি আইসক্রিমের পসরা সাজিয়ে বসেন, যে রিকশাচালক রোজ কচিকাঁচাদের বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে আয়ের উৎস খুঁজে পাযন, যে মহিলারা মাথায় চা-পাতার ঝুড়ি নিয়ে চা-বাগানে পাতা তুলতে যান, যে মহিলা সাতসকালে মালকিনের ঘুম ভাঙার আগেই পরিচারিকার কাজ করতে পৌঁছে যান, যে মানুষটা আপনাকে গাড়ি চালিয়ে কর্মস্থলে নিয়ে যান, যে মানুষগুলো ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে তিলতিল করে আপনার স্বপ্নের মহলকে বাস্তব রূপ দান করেন, যে মানুষগুলো মন্দির-মসজিদ-গির্জার সামনে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বসে থাকেন, তাঁদের প্রত্যেকের গলায় একটাই আকূতি— কী ভাবে জুটবে খাবার!

এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি মানবিক হতে হবে। এই পৃথক থাকার কারণে আপনার বাড়ির পরিচারক বা পরিচারিকা, গাড়ির চালক, বাগানের মালি কিংবা দোকানের কর্মচারী, অর্থাৎ আপনার উপর নির্ভরশীল কারও বেতনে যেন কোপ না পড়ে। এ ছাড়াও অসংগঠিত শ্রমিক, ভিক্ষাজীবী এবং দারিদ্রসীমার নীচে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জন্য সরকার যদি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তবেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে পৃথক থেকে এই মারণ ভাইরাসকে আমরা পরাস্ত করতে পারব।

(লেখক দিনহাটার গোপালনগর এমএসএস হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement